বিএসইসিকে সাধুবাদ: তবে উদ্যোগ নিতে হবে পতন অসহনীয় হওয়ার আগেই
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একটি ইশারাতেই গত কয়েকদিন ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাজার। যদিও বাজার যে পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তার চেয়ে নিচে নামার আর কোন রাস্তা ছিলনা। তারপরও আমরা মনে করি শেষ পর্যায়ে হলেও বাজার ধরে রাখার জন্য বিএসইসির উদ্যোগটিতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। তারা এতোদিন অব্যাহত পতন দেখতে দেখতে বাজার নিয়ে যে হতাশায় ভুগছিলেন অন্তত এবারের উদ্যোগটিতে তাদের সে হতাশা কেটে গেছে। বাজার বাড়ানোর ব্যাপারে বিএসইসির নির্দেশনার ঠিক একদিন পর সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রীও বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ঠিক একই দিন বিকেলে নবগঠিত সংগঠন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট ফোরাম (বিএফএমএফ) একটি বৈঠকে বসে সেল প্রেশার কমিয়ে বাজার স্থিতিশীল করার ঘোষণা দিয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন এবং সরকারের ওই মন্ত্রীর প্রতি আমাদের সাধুবাদ। আমরা বরাবরই বিনিয়োগকারীদের পক্ষে। অব্যাহত বাজার ভালো হোক আমরা সেটিও যেমন চাইনা তেমনি দিনের পর দিন বাজার পতনে থাকুক সেটিও আমাদের প্রত্যাশা বা কারোরই কাম্য নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের লেখনি দিয়ে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন তারা যা করছে সেগুলো বাস্তবায়নের আহবান জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু আমরা জানিনা এটা কি আমাদেরই দুর্ভাগ্য নাকি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মন্দ কপাল যে, একেবারে তলানিতে না যাওয়া পর্যন্ত কেউই বাজার স্থিতিশীলতার জন্য পদক্ষেপ নেয়না। গত কয়েক দিনের পত্রিকা বিশ্লেষণ করলে একথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলবে।
সম্প্রতি শেয়ারবাজারনিউজ ডটকম পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত তাদের পুঁজি হারাচ্ছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক ফোর্সসেলের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। আর এ ব্যাপক দরপতনের নেপথ্যে ছিল বেশকিছু সিকিউরিটিজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে ব্যাপক সেল প্রেসার তৈরি করা। যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত সেল প্রেসার তৈরি হয়েছে তাদের ছাড়াও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কোনোরুপ নোটিশ ছাড়াই জরুরিভিত্তিতে ওই দিন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। ওই বৈঠকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনতিবিলম্বে বাজার ভালো করার নির্দেশ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সেল প্রেসার কমিয়ে শেয়ার কেনার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ইক্যুইটির সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিটের ২৫ শতাংশ ও কনসোলিটেড এক্সপোজার লিমিটের ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ করার আইন রয়েছে। এক্ষেত্রে কনসোলিটেড এক্সপোজার লিমিটের বিষয়টি শিথিল করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাজারে নগদ অর্থ বাড়াতে নিটিং সুবিধা চালু করার পাশাপাশি ব্র্যাঞ্চ অফিসগুলো চালু করার দাবি তুলেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োকারীরা।এদিকে গত ২৭ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকেও বিএসইসির চেয়ারম্যান বরাবর একটি নোটিশ পাঠানো হয়। যেখানে বাজার ভালো করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা কারণে পুঁজিবাজারে গত কয়েক মাসে সেল-প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিকভাবে ক্রমাগত সূচকের পতন ঘটলে নবগঠিত সংগঠন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট ফোরাম (বিএফএমএফ) বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এই সেল-প্রেশার কমানোর উদ্যোগ নেয়। গত বুধবার সংগঠনটির প্রথম সভাতেই বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রনালয়ের সাথে সমন্বিতভাবে কর্মপদ্ধতি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ওইদিন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এমনটাই আলোচনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক আহসানুল ইসলাম টিটু। সভায় প্রথমেই উঠে আসে, গত কয়েকদিনের সেল-প্রেশারের কারণে বাজারের নিম্নমুখী প্রবনতার ব্যাপারটি। বৈঠকে উপস্থিত নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট সংক্রান্ত নির্দেশনার কারনে বেশিরভাগ বানিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারে তাদের বিপুল বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। আর কেন্দ্রিয় ব্যাংক এ সময়সীমা ২০১৬ সালের ১জুন ঠিক করে দেয়ায় অতিরিক্ত এক্সপোজারে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে।এ কারনেই বাজারে সার্বিক সূচক ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। এ দূরাবস্থা কাটাতে তাই কেন্দ্রিয় ব্যাংককে নমনীয় মনোভাব দেখানোর জন্য প্রস্তাবনা দিতে যাচ্ছে সংগঠনটি।
পুঁজিবাজর সংশ্লিষ্ট শীর্ষ অনলাইন পত্রিকা শেয়ারবাজার নিউজ ডচকমের অপর এক খবরে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারের দৈন্যদশায় অবশেষে সরকারের টনক নড়েছে । আর এই উপলব্ধি থেকেই পুঁজিবাজারের এই করুণ অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক-কে দায়ী করে তাদের এ খাতের প্রতি নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
খবরে বলা হয়, ৬ মে সকালে এমসিসিআই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘মেডিয়েশন ফর সেটেলমেন্ট অব কমার্শিয়াল ডিসপিউটস অ্যান্ড রিকভারি অব ওভারডিউ ব্যাংক লোন’ শীর্ষক এক সেমিনারে বানিজ্যমন্ত্রি তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংক-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যখন নির্দেশ দিল ১০শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তখন ওই মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে। তাদের ১০ টাকার পুঁজি এখন ৫ টাকা হয়েছে। তারা কার কাছে ডিসপিউটস দিবে। তাদের জন্য কিছু ভাবুন।’
বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় একদিকে যেমন পুঁজিবাজারে ধসের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের কথা উঠে আসে, তেমনিভাবে এ ব্যাপারে সরকার যে নতুন করে ভাবা শুরু করেছে তাও পরিষ্কার হয়েছে।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে তা হলো এতদিন আসলে কোন কোন মহলের স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্তের আলোকেই বাজারের পতন ঘটেছে যে মহলটির সাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরিচিত। ফলে পতনের মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে সংস্থাটি অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদেরকে ডেকে ধমক দিতে কিংবা বাজার স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে অনুরোধ জানানোর পথ বেছে নেয় এবং তাতে কাজও হয়। এখন আমাদের কথা হচ্ছে এ ধরণের উদ্যোগ নেয়ায় আমরা না হয় বিএসইসিকে সাধুবাদ জানালাম কিন্তু তারপরও কথা থেকে যাচ্ছে। বিএসইসি সেই উদ্যোগ যখন নিলই সেটা আগে নিলনা কেন? গত সপ্তাহে টানা তিনদিন বাজার বাড়ার পর এই প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে। বিএসইসির কাছে এই প্রশ্নের কি জবাব আছে আমরা জানিনা্। তারপরও আমরা মনে করি সাধারণ বিনিয়োগকরীদের ক্ষতি হওয়ার আগেই এই সংস্থাটির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আগামিতে অন্তত কোন মহলের স্বেচ্ছাচারি বাজার ফেলে দেয়ার জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই বিএসইসি যাতে বাজার ধরে রাখতে পারে আমরা সেই প্রত্যাশাই করছি।
শেয়ারবাজারনিউজ/শা/সা/তু/রু