আজ: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৩ মে ২০১৫, শনিবার |

kidarkar

থাইল্যান্ডের পুরো সমাজ মানবপাচারে জড়িত,বিবিসির প্রতিবেদন

manobশেয়ারবাজার ডেস্ক: থাইল্যান্ডে মানব পাচারের ইতিবৃত্ত খুঁজে বের করতে বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জনাথন হেড দেশটির তিনটি প্রদেশে সরেজমিন অনুসন্ধান চালান। তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে লোমহর্ষক সব চিত্র। বের করার চেষ্টা করেছেন পাচারের পেছনের রাঘব বোয়ালদের। বিবিসির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, থাইল্যান্ডের পুরো সমাজ মানবপাচারকারীদের সহায়তা করছে। গত মাসের শেষ দিকে আন্দামান সাগরে থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপে পাচারের শিকার মানুষের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবর যখন বাতাসে ভাসছে, তখন একদল থাই স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে ওই এলাকায় যান বিবিসির এই প্রতিবেদক। পাচারকারীরা কীভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, ভাগ্য বদলের আশায় কাঠের নৌকায় সাগরে ভাসা মানুষকে জিম্মি করে কীভাবে তারা মুক্তিপণ আদায় করছে, এবং থাই প্রশাসন কীভাবে তাতে সহযোগিতা দিচ্ছে তার বিস্তারিত উঠে এসেছে শুক্রবার বিবিসিতে প্রকাশিত হেডের প্রতিবেদনে। থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে হেড দেখেছেন পাচারকারীদের ব্যবহার করা স্থানগুলো। সেখানে এখনও যত্রতত্র পড়ে আছে মৃত মানুষের হাড়গোড়। পাচারকারীদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে আসা উদ্ধারকৃতদের চোখে মুখে আতঙ্ক আর বিভীষিকার চিত্র তুলে ধরেছেন প্রতিবেদনে। তিনি লিখেছেন—এ মাসের শুরুর দিকে আন্দামান উপকূলে একটি দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বনে প্রবেশ করি। সঙ্গে ছিল কয়েকজন থাই স্বেচ্ছাসেবী। ওই দ্বীপে বেশ কয়েকটি কবরের খবর পেয়েছিল তারা। ধারণা করা হচ্ছিল, ওই দ্বীপ মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করতো। সেখানে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক অভিবাসীদের রাখতো পাচারকারীরা। এক দ্বীপের একটি স্থানে কিছু হাড়গোড়ের সন্ধান পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাটি খোঁড়া শুরু হয়ে গেল। কিছুটা গভীরে খোঁড়ার পরই আর্দ্র জামার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। সেটার ভেতরেই এক মহিলার হলদে হাড় দেখা গেল। এ মহিলা কে বা কীভাবেই তিনি মারা গেলেন, আমরা এখনও জানি না। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, তিনি অভিবাসীদের একজন। এখানে আসতে তাকে নিশ্চয়ই বিশাল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। মালয়েশিয়ায় আরেকটু ভাল জীবন বুনার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু তার আগেই মারা গেলেন তিনি। কে জানে! হয়তো মারা না গেলে আরও খারাপ ভাগ্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য। মানব-বাণিজ্য গত অক্টোবরে আমি প্রায় একই এলাকায় ছিলাম। তাকুয়া পা জেলায় বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে সরকারি কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন। এ খবর পেয়ে আমরা ব্যাংকক থেকে সেখানে ছুটে যাই। কমিউনিটি হলে আমরা ৮১ জন মানুষকে দেখতে পাই। তাদের চেহারায় ভয়াবহ চাপের ছাপ ছিল স্পষ্ট। আমরা তাদের প্রার্থনারত অবস্থায় দেখতে পাই। এ সময় তাদের প্রায় প্রত্যেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারে নির্যাতন চলছে। কিন্তু এরা কেউই রোহিঙ্গা ছিল না। এরা ছিল বাংলাদেশি। এদের কেউ কেউ আমাদের বলেছেন, তাদেরকে জোর করে নৌকায় তুলে এখানে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রধান মানিত পিয়ানথং আমাদের নিয়ে যান এ অভিবাসীদের উদ্ধার স্থলের দিকে। জায়গাটি ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বেশ কয়েকদিন আগে আমরা যে মহিলার কবরের সন্ধান পেয়েছিলাম, এ জায়গাটি তার চেয়ে বেশি দূরে নয়। এ জঙ্গলে অভিবাসীদের বহুদিন না খাইয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পেটানো হয়েছে। মানিত আমাদের জানালেন, তার জেলাকে অনেকদিন ধরে মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। তিনি এটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় আইনি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তিনি তেমন সাহায্য পাননি। হেডের দাবি, তিনি বেশ কয়েক দিন ধরে মনিতকে সরকারি ও পুলিশের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের ফোন ধরায় ব্যস্ত থাকতে দেখেছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় তারা মনিতকে ধমকাচ্ছিলেন। মানিতকে উদ্ধারকৃত বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠাতে বলা হলো। কিন্তু এটা একটি ওপেন সিক্রেট যে, ওই সরকারি বন্দি-কেন্দ্রে আটক অভিবাসীদের প্রায়ই আবার মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। মানিত নিজের লোকদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজে লাগালেন। যাতে করে এমন আরও বন্দিশিবিরের খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি প্রধান সড়কে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়া স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানালেন যাতে কোন নৌকা আসতে দেখলে তাকে জানানো হয়। হেড লিখেছেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের আগমন বাড়তে থাকা এটাই প্রমাণ করে, আদম ব্যবসা বিস্তৃত হচ্ছে। আর এটা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। হেড তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মানবপাচার ব্যবসার মডেল তুলে ধরেছেন। তার বিবরণ মতে, থাই পাচারকারীচক্র অভিবাসন-প্রত্যাশীদের নৌকাবোঝাই করে আনে। থাই পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ৩০০ মানুষ বোঝাই একটা কার্গোর দাম ২০ হাজার ডলার বা তার বেশি। পরিবারের কাছ থেকে জনপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার ডলার মুক্তিপণ আদায় করা পর্যন্ত ওই অভিবাসন-প্রত্যাশীদের জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। থাই গ্রামবাসীর সামনে পাচারকারীরা কীভাবে এই ব্যবসা চালাচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁতে গিয়ে হেড জানিয়েছেন, পাচারকারীরা তাদের ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় লোকদের যুক্ত করেছে। থাইল্যান্ডে হেডের দেখা একটি মানবপাচার ক্যাম্পের কাছের একটি গ্রামের এক মুসলিম যুবকের ভাষ্য, অর্থের জন্য পুরো গ্রামবাসী মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত। পাচারকারীরা সবাইকে ভাড়া করে। ক্যাম্পের ওপর নজরদারি এবং খাবার সরবরাহের জন্য পাচারকারীরা লোক ভাড়া করে। লোক ভাড়া করতে তারা গ্রামের ঘরে ঘরে যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ হেড জানারচ্ছন, কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এসব করতে পারতো না মানব পাচারকারীরা। তবে ঠিক কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসবে জড়িত ছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, খুবই উঁচুপর্যায় থেকে এসবে সায় ছিল। গত বছরের শেষ দিকে, আমাকে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা অনেক কিছু বলেন। ওই কর্মকর্তা মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ে অনেক কিছুই জানেন। তিনি আমাকে বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে থাই সীমান্তেই অনেক বড় একটি বন্দিশিবির রয়েছে। সেখানে অন্তত ১ হাজার মানুষকে আটক রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তারা পুলিশ নিয়ে সেসব বন্ধ করছে না? প্রশ্ন শুনে সে হেসে দিলেন। তিনি বলেন, আপনি তো জানেনই যে সীমান্ত হচ্ছে সামরিক এলাকা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সেখানে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। এই অনুমোদন তিনি কখনই পাননি। আমি প্রশ্ন করলাম, তিনি কেন প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান প্রায়ুথ চ্যান-ওচা’র কাছে যাননি? তিনি গত বছর সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর মানব পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে উত্তরে বললেন, আমি যদি তা করি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাওয়ার আগেই মানব পাচারকারীদের সতর্ক করে দেয়া হবে। ফলে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যাবে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ছয় মাস পর ২৬ জনের মৃতদেহসহ প্রথম গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটিই ছিল সেই বন্দিশিবির যেটি ওই পুলিশ কর্মকর্তা অসহায়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। হেড লিখেছেন, এটি বের করা খুব কঠিন, কারা এসবে জড়িত; কারা জড়িত নয়। স্থানীয় এক পুলিশ প্রধান মানব পাচার বন্ধে তার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমাদের জানান। এমনকি তিনি তার নৌকা নিয়ে আশেপাশে ঘুরে অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেন আমাদের। ঠিক একদিন পর আমরা সামরিক বাহিনীর একটি ইউনিটের সঙ্গে অনুসন্ধানে যাই। ওই ইউনিট আমাদের জানায়, ওই স্থানীয় পুলিশ প্রধানই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ওই সেনারাই বা কতটুকু মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তা নিয়েই আমরা সংশয়ে পড়ি কিছুক্ষণ পর। একটি গ্রামে অভিবাসীদের লুকিয়ে রাখা হতে পারে বলে আমাদের ধারণা ছিল। সে গ্রামটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু আগে কথা দিলেও, এবার ওই গ্রামে আমাদের নামাতে রাজি হয়নি সেনারা! এক কর্মকর্তা আমাদের তার তদন্তের বিস্তারিত দেখালেন। সেখানে রানোং প্রদেশের নামিদামি অনেক ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ আছে। রানোং প্রদেশ অনেকদিন ধরে মানব পাচারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তার কাছে নাম, ফোন নম্বর, ফোন কলের সময় ও বড় ধরনের নেটওয়ার্কের প্রমাণ আছে। এ তথ্যসমূহ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গূঢ় রহস্য হচ্ছে, সরকার এসব জেনেও কিছুই করেনি। ওই কর্মকর্তাকে পরে বদলি করে দেয়া হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বললেন, দেখুন, সবাই জানে যে ওখানে বন্দিশিবির আছে। এটা এমন নয় যে, কেবলমাত্র গ্রামবাসী বন্দিশিবিরে জড়িত ও পাহারার কাজ করে। অথচ থাই-মালয়েশিয়া সীমান্ত সম্পূর্ণ সামরিকীকৃত। সেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী গিজগিজ করছে। কারো পক্ষেই ওই এলাকায় ‘প্যাকেট’ বিনিময় ব্যতীত এত বড় আকারের বন্দিশিবির পরিচালনা করা সম্ভব নয়! বন্ধ হবে কবে: এবার আরেকটি সরকারি হলে গেলাম। দুইদিন আগে সেখানে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে রাখা হয়েছে। তাদের বন্দিশিবির যারা পাহারা দিচ্ছিল, তাদের পাশেই পুলিশ আটক করে রেখেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আমার একটি প্রশ্ন ছিল। তাদের কতজন চিন্তিত ছিল যে, তাদের পরিবার হয়তো পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক মুক্তিপণ দিতে পারবে না দালালদের? এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবাই-ই হাত তুললো! রাখাইন স্টেটের এক রোহিঙ্গা শিক্ষক মোহাম্মদ জানালেন, আমরা এখানে আসতে চাই না। আমাদের মাতৃভূমি ছাড়তে চাই না। কিন্তু আমাদের আসলে যাবার কোনো জায়গাই নেই। মিয়ানমার সরকার খুবই খারাপ। তারা আমাদের পেটায়, গুলি মেরে হত্যা করে। কিন্তু এসব শিবিরে কি হয়, তা জানতেনই না মোহাম্মদ। একপর্যায়ে তিনি পালাতে পেরেছিলেন; কিন্তু আবার ধরা পড়েন পাচারকারীদের হাতে। একটি সামরিক সূত্র আমাদের জানায় যে, রানোং-এ একটি সরকারি অভিবাসী বন্দি-কেন্দ্রে আটককৃত অনেক রোহিঙ্গাকে রাখার পর তাদের আবারও মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এর আগেও এমন হয়েছে। তারা মূলত মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক ছিল। সেখানে চাকরি, পরিবার ও ভাল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল তারা। কিন্তু বাংলাদেশিদের তবুও যাবার জায়গা আছে। প্রথমে অল্প কয়েকজন বাংলাদেশিকে জোর করে পাচার করা হয়েছিল। কিন্তু পরে লোভে পড়ে অনেকে জেনে বুঝে সমুদ্র পথে পাড়ি জমাতে রাজি হয়। উচ্চ বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের মুঠোয় আনে পাচারকারীরা। কিন্তু এ অবৈধ ব্যবসার নির্মম বাস্তবতা উপলব্ধি করার পর তাদের অনেকেই বাড়ি যেতে চেয়েছে। এ ব্যবসা এতই জমজমাট যে, এখন থাই পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে আগে থেকেই দালালদের ভাল একটি নেটওয়ার্ক আছে। যদি ওই নেটওয়ার্কগুলো ভাঙ্গা যায়, তাহলে মুহূর্তেই সেখান থেকে অভিবাসী আসার হার কমে যাবে।

 

শেয়ারবাজারনিউজ/অ/তু

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.