আজ: বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৪ অক্টোবর ২০২১, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকার কী হবে?

রাসেল মাহমুদ: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের ৩৯৭ কোটি টাকাসহ অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে পেমেন্ট গেটওয়ে (এসক্রো) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফস্টার পেমেন্টস’। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৬০০ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। বিপুল পরিমান এই অর্থ নিয়ে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা। আবার প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিতও নয়। ফলে আটকে থাকা টাকা ফিরে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না থাকায় ফস্টারের কোনো দায়ও নিতে চাচ্ছে না ব্যাক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ফস্টার পেমেন্ট আমাদের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই।

জানা গেছে, ইভ্যালিসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নেয়ার পরও পণ্য ডেলিভারি না দেয়ার অভিযোগে গত ৪ জুলাই এসক্রো সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ পদ্ধতিতে ক্রেতারা কোন ই-কমার্স কোম্পানিতে পণ্য অর্ডার করে মূল্য পরিশোধের পর তা পেমেন্ট গেটওয়ে সেবাদানকারী ফস্টারসহ বিভিন্ন কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হয়। ই-কমার্স কোম্পানি ওই পণ্য ক্রেতাকে ডেলিভারি দেয়ার পর তার ডকুমেন্ট দাখিল করার পর পেমেন্ট গেটওয়ে ক্রেতার পরিশোধ করা মূল্য ই-কমার্স কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে।

এসক্রো সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকেই ফস্টারসহ বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হতে থাকে।

কিউকমসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা বলছেন, যে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনই নাই তারা কীভাবে ব্যবসা করছিলো। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি জানতো না তা হতে পারে না। সরকারও এ দায় এড়াতে পারে না।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, শুনেছি, কিউকম ও তাদের পেমেন্ট সিস্টেমে ঝামেলা ছিলো। তারা আমাদের থেকে টাকা নিয়েছে। আমাদের পণ্যের দরকার নেই, দ্রুত টাকা ফেরত চাই।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম শেয়ারবাজারনিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়, সেসব প্রতিষ্ঠান আইন বহির্ভূত কিছু করলে আমরা তাদের ধরতে পারি। ফস্টার আমাদের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের প্রতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।

তিনি বলেন, যদি অনুমোদন নিয়ে কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান আইন অমান্য করে তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, ই-পেমেন্ট গেটওয়ে বা ই-ওয়ালেট সেবা দিতে বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশনস-২০১৪-এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। এর মধ্যে ই-পেমেন্ট গেটওয়ে সেবার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে পাঁচটি এবং ই-ওয়ালেট সেবার জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু কিউকম যে গেটওয়ে ব্যবহার করেছে তাদের কোনো অনুমোদনই ছিলো না।

বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরতের উদ্যোগ বা ফস্টারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না চাইলেও কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। এ জন্য একটি কমিটি করেছে ক্যাব।

বিষয়টি নিয়ে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান শেয়ারবাজারনিউজকে বলেন, কেউ যদি প্রতারিত হবেন জেনেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত নয়- এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করেন তাদের রক্ষার কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। তবে ইতিমধ্যে যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাদের টাকা কীভাবে উদ্ধার করা যায় তা নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এজন্য ‘পেমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট ২০২১’-এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে।

জানা গেছে, সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে মোটরসাইকেল, মোবাইল, ইলেক্ট্রনিকস ও ফ্যাশন আইটেম বিক্রয়ের জন্য ‘তারুণ্যের মার্কেটপ্লেস’ নাম করে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে কিউকম। পণ্য মূল্য পরিশোধের তারিখ হতে সর্বনিম্ন ২১ ও সর্বোচ্চ ২৫ কর্মদিবসের মধ্যে ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কেউই তাদের পণ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাননি।

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত ও পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুরোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ফস্টারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়। পাশাপাশি কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রিপন মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তিনি জানান, পেমেন্ট গেটওয়েতে গ্রাহকের ৩৯৭ কোটি টাকা ও বিভিন্ন সময়ে রিপন মিয়া নিজেও গ্রাহকের ২৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে।

গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে ১৩ অক্টোবর ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান কিউকম লিমিটেড ও মালিক রিপন মিয়ার ব্যাংক হিসাব ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করে লেনদেনের তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ। ওই চিঠিতে রিপন মিয়ার মালিকানাধীন জেএমআর ডিজিটাল ইন্টারন্যাশনাল ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সব হিসাব (ইসলামী ব্যাংকিংসহ) অতীতে বা বর্তমানে পরিচালিত হয়ে থাকলে সেসব হিসাবের যাবতীয় তথ্য দিতে বলা হয়েছে। এমনকি তাদের নামে ফিক্সড ডিপোজিট, ঋণ হিসাব, এলসি খোলা হলে সে তথ্যও দিতে হবে। একই সঙ্গে নমিনির তথ্য ও নমিনিদের নামে কোনো হিসাব পরিচালিত হলে সেগুলোরও বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।

বিষয়টি নিয়ে ফস্টার পেমেন্টের কর্পোরেট ফাইন্যান্স বিভাগের সিনিয়র জিএম মো. আল বেরুনীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি এসএমএস পাঠিয়েও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স ছাড়া পেমেন্ট গেটওয়ে সেবাদান বন্ধে ‘পেমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট ২০২১’- আইনের খসড়া তৈরি করেছে। এতে আইন অমান্য করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং মামলা হলে তা জামিন অযোগ্য হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

আইনের খসড়া সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পেমেন্ট সিস্টেমের ঝুঁকি হ্রাস করা ও গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষায় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘনের দায়ে দেশে কার্যরত সকল পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই আইনের অন্যতম অপরাধ হলো, লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হয়ে পরিশোধ কার্যক্রম পরিচালনা করা বা প্রাপ্ত লাইসেন্স বাতিল হবার পরও পরিশোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।

আইনে কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা পরিচালক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে না। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব বই নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বাংলাদেশ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অর্ডার ১৯৯৩’ এর ২ এর উপধারায় আইন অনুসারে যোগ্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে অডিটর হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বা একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারবে।

জানা গেছে, এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতারা যেসব অর্ডারের মূল্য পরিশোধ করেছেন, সেসব অর্থও পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে আটকে রয়েছে। সেই সব অর্ডারের কি পরিমাণ ডেলিভারি হয়েছে বা হয়নি, তার তথ্য পেমেন্ট গেটওয়েতে সরবরাহ করেনি ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। তাই এসক্রো সার্ভিসের আওতায় এসব কোম্পানিতে অর্ডারকারী গ্রাহকদের পাওনা কোটি টাকা ফেরত পেতে দেরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসক্রো সার্ভিস সুবিধায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কোন পণ্যের অর্ডার করার পর ক্রেতা পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে তার দেওয়া অর্ডার বাতিল ও অর্থফেরত কিভাবে নিবে সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২ উত্তর “পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকার কী হবে?”

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.