আজ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ইং, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৫ নভেম্বর ২০২১, সোমবার |

kidarkar

সীমিত ব্যবসা ও ব্যাপক ব্যাংক ঋণ,ইচ্ছেকৃত ভাবে ব্যয় ও খরচ বাড়িয়ে মুনাফা বন্ধ

পরিচালক ও ব্যবস্থাপনারা ব্যবসায় আগ্রহী কম: হুমকির মুখে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবসা

আতাউর রহমান: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের সীমিত ব্যবসা ও ব্যাপক ব্যাংক ঋণ থাকায় ব্যবসার স্থায়িত্ব হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শনকারী দল। সেই সাথে আর্থিক প্রতিবেদনে ইচ্ছেকৃত ভাবে ব্যয় ও খরচ বাড়িয়ে মুনাফা বন্ধ করে দেওয়া এবং ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোম্পানিটির পরিচালক ও ম্যানেজমেন্ট উভয়েরই আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জের বিধি-বিধানসহ সিকিউরিটিজ আইন ধারাবাহিক ভাবে লঙ্ঘন করেই চলেছে।

গত ১৩ জুন কোম্পানিটির কারখানা প্রাঙ্গণ ও ১৪ জুন প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে স্টক এক্সচেঞ্জ। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের প্রধান কার্যালয় ও কারখানা প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করে এমন সব তথ্য পেয়েছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।কোম্পানিটির এসব অসঙ্গতি ডিএসই প্রতিবেদন আকারে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) পাঠিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ডিএসই উল্লেখ করেছে, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবসার স্থায়ীত্ব মূলত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্রেতার চাহিদা বা ওয়ার্ক অর্ডারের উপর নির্ভরশীল। কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে বিশ্ব এক নতুন মাত্রায় পরিকল্পিত হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন না। একইসঙ্গে প্রতিযোগীতামূলক খরচ প্রস্তাব করে এমন নির্মাতা খুঁজছেন জাহাজ নির্মাতারা। সেদিকে বিবেচনায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের জাহাজ নির্মাণে শুধুমাত্র একটি পণ্য লাইন রয়েছে। এতে বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্বে, ব্যবসায়িক বৈচিত্র্য না থাকলে কোম্পানিটির ব্যবসায়িক স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। একইসঙ্গে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের প্রচুর পরিমাণে ব্যাংক ঋণ রয়েছে। এ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। বর্তমান কোম্পানিটির যে পরিমাণ আয় হয়, তা দিয়ে এ ঋণ ভবিষ্যতে পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের আইন লঙ্ঘন ও অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানিটি নিয়মিতভাবে মাসিক শেয়ারহোল্ডিং অবস্থা এবং ফ্রি ফ্লোট রিপোর্ট দাখিল করে না। ফলে কোম্পানিটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (লিস্টিং) রেগুলেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৩৫(১) ও (২) লঙ্ঘন করছে। একইসঙ্গে কোম্পানিটি গত সাত বছর ধরে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির বার্ষিক ফি প্রদান করছে না। ফলে কোম্পানিটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (লিস্টিং) রেগুলেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৪২ ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘণ করছে।

এছাড়া কোম্পানিটির পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী বলে মনে হয়নি। দেশের শেয়ারবাজারের এ কোম্পানিটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়াতে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

এছাড়া প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ৩০ জুন সম্পাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে নোট ৬-এ ইনভেন্টরির (মজুদ পণ্য মূল্যায়ন) মূল্য ছিল ৪৯৪.৭৯ কোটি টাকা। ইনভেন্টরিগুলোর একটি সঠিক তালিকা এবং তাদের মূল্য বোঝার জন্য কোম্পানি যথাযথ নথিপত্র কোম্পানি অজুহাত দেখিয়ে প্রদান করেনি। ফলে পরিদর্শন দল সঠিক নথিপত্রের কারণে ইনভেন্টরি যাচাই করতে পারেনি। এছাড়া কোম্পানিটির অডিটর আর্থিক প্রতিবেদনে ইনভেন্টরিজ সম্পর্কে আপত্তি বা কোয়ালিফাইড অপিনিয়ন জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বছরের শেষে ইনভেন্টরির মূল্যায়নের ফলে ইনভেন্টরির ব্যালেন্স ৪৯৪.৭৯ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্ট দ্বারা প্রত্যয়িত। আর রিপোর্টিং তারিখে অনুষ্ঠিত ইনভেন্টরির বাজার মূল্য নির্ধারণের জন্য এই ধরনের মূল্যায়ন সম্পাদনের সঙ্গে জড়িত অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার কারণে, কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্ট ওই ইনভেন্টরিগুলোকে নিট বাস্তবতার পরিবর্তে গড় খরচ হিসবে ধরেছে। তবে কোম্পানিটি ইনভেন্টরিগুলোর ওপর কোনও ক্ষতির চার্জ ধার্য করেনি। ফলে কোম্পানিটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ২ ‘ইনভেন্টরিজ’ এর অনুচ্ছেদ ৯ ও ৩৪ পরিপালন করেনি। এতে কোম্পানির নিট মুনাফা ও ইপিএস বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

পাশাপাশি ২০২০ সালের ৩০ জুন সম্পাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে নোট ৭.৩-এ প্রিপেমেন্ট, ডিপোজিট ও অগ্রিম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬০.২০ কোটি টাকা। কিন্তু পরিদর্শক দল নোটে প্রিপেমেন্ট, ডিপোজিট এবং অগ্রিম সংক্রান্ত আর্থিক বিবৃতিতে কোন বিস্তারিত তথ্য পাইনি। আর কোম্পানি উল্লিখিত পরিমাণ হিসবি যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় নথি প্রদান করেনি। তাই পরিদর্শন দল মনে করে, কোম্পানিটি কাল্পনিক বা অতিরিক্ত প্রিপেমেন্ট, ডিপোজিট এবং অগ্রিম হিসাব নির্ধারণ করেছে। ফলে কোম্পানিটি অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ১ ‘আর্থিক বিবৃতি উপস্থাপনা’ এর অনুচ্ছেদ ১৫ ও ১৮, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর ধারা ১৮ এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (লিস্টিং) রেগুলেশন, ২০১৫ এর রেগুলেশন ৪৫ পরিপালন করেনি। এটি একটি চরমতম লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কোম্পানি সচিব মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘এখন আমি মিটিংয়ে আছি। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই’র প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা (সিওও) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার শেয়ারবাজার নিউজকে বলেন, ‘ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের প্রধান কার্যালয় ও কারখানা প্রাঙ্গণ পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রতিবেদন আমরা বিএসইসিতে জমা দিয়েছি। বিএসইসি সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের গত ২২ এপ্রিল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সশরীরে পরিদর্শনের অনুমতি পায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই) কর্তৃপক্ষ। ওইসব কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সশরীরে কোম্পানি পরিদর্শনের অনুমতি দিয়েছে বিএসইসি। এ পরিদর্শন কার্যক্রমে কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতার পাশপাশি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম যাচাই করা হচ্ছে। এসব কোম্পানিগুলোকে নিয়ে শেয়ারবাজারে অনেক গুজব রয়েছে। তাই ওই গুজবের সত্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য সশরীরে কোম্পানিগুলো পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। এরই ধরাবাহিকতায় চলতি বছরের গত ১৩ জুন কোম্পানিটির কারখানা প্রাঙ্গণ ও ১৪ জুন প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

অন্যান্য কোম্পানিগুলো হলো- নূরানি ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, কাট্টালি টেক্সটাইল ও আমান ফিড।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.