আজ: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০২ জানুয়ারী ২০২২, রবিবার |

kidarkar

৩ বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি

এ জেড ভূঁইয়া আনাস: দেশে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। প্রতিদিনই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। জরুরি প্রয়োজনে যেকোন সময় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে সহজেই টাকা পাঠানোর সুবিধা এই খাতকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করছে। এতে ব্যাংকিং সেবায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে ১৩টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। আর মাত্র ৩৫ মাসের ব্যবধানে এই মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা একক মাস ও দৈনিক লেনদেনে এ যাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে লেনদেন হয়েছিলো ৩২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। ওই সময় প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছিলো এক হাজার ৩৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে মাত্র ৩৫ মাসের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৬৫ হাজার ১৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকার । ওই মাসে দৈনিক লেনদেন হয় দুই হাজার ১৭১ কোটি টাকা । এখন পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় গত মে মাসে। ওই মাসে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। আর দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের অক্টোবর মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায়েছে ১০ কোটি ৮১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০ জন। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক পাঁচ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার ১৯১ জন। আর নারী গ্রাহক চার কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ১৯৪ জন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ছিলো ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৬ হাজার ৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ গ্রাহক তিন কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৯ জন। আর নারী গ্রাহক তিন কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯১০ জন।

চলতি বছরের অক্টোবর শেষে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে শহরে এজেন্ট ছয় লাখ ৪০হাজার ১২৬ জন। আর গ্রামের এজেন্ট পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৬৫ জন। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা ছিলো ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭১ জন। এর মধ্যে শহরে এজেন্ট চার লাখ ৮১হাজার ২২ জন। আর গ্রামের এজেন্ট চার লাখ পাঁচ হাজার ৪৪৯ জন।

নগদের হেড অফ কমিউনিকেশন সজল জাহিদ শেয়ারবাজার নিউজকে বলেন, এমনিতেই মানুষের জীবন অনেক বেশি ডিজিটাল হচ্ছে। সবাই এখন ডিজিটাল সার্ভিসগুলো গ্রহণ করছে। এছাড়া এমএফএসের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে করোনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে কারণে মানুষ এখন নগদ টাকা কম বহন করে অনেক বেশি ডিজিটাল পেমেন্ট করছে। অন্যদিকে সরকার ও কোম্পানিগুলো যেসব সুযোগ-সুবিধাগুলো দিচ্ছে সেগুলোও এখন এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিচ্ছে। যার কারণে অনেক মানুষ অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসব পেমেন্ট সিস্টেমে ঢুকতে হচ্ছে। নগদের মাধ্যমে গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি মানুষকে সরকার ৮ কোটি বার বিভিন্ন ভাতা দিয়েছে। অর্থাৎ কোন কোন ব্যক্তি একই ভাতা একাধিকবারও পেয়েছেন। এই ভাতাগুলোর পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছিলো বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

শুধু অর্থ পাঠানোই নয়, অনেক নতুন নতুন সেবাও মিলছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান ও বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোসহ (রেমিট্যান্স) বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে।

উপায় এর হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশনস এন্ড এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স জাহেদুল ইসলাম শেয়ারবাজার নিউজকে বলেন, দেশ ডিজিটালাইজেশনের ফলে মানুষ এমনিতেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছিলো। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই ব্যবস্থা বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়। এবং সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় যে ভাতাগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া করোনার সময় গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে অন্যান্য কোম্পানিগুলোও কর্মচারিদের সুবিধার্থে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেতন ভাতা দেওয়া শুরু করে। এতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধাগুলো তাদের নজরে আসায় এখন এর মাধ্যমেই বেতন পরিশোধের প্রবণতা বেড়েছে বলেও মনে করেন উপায়ের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় টাকা জমা পড়ে (ক্যাশ ইন) ২১ হাজার ৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর ১৭ হাজার ৬৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন (ক্যাশ আউট) হয়। এ মাসে কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয় দুই হাজার ৯৫৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় টাকা জমা পড়ে (ক্যাশ ইন) ১২ হাজার ২৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ১২ হাজার ২১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন (ক্যাশ আউট) হয়। এ মাসে কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয় মাত্র ৪৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

চলতি বছরের অক্টোবরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে ব্যক্তির হিসাব থেকে আরেক ব্যক্তির হিসাবে ১৯ হাজার ৭১০ কোটি ৪০ টাকা পাঠানো হয়। এ ছাড়া অক্টোবর মাসে কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় দুই হাজার ৩৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ হয় এক হাজার ৩৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকার। আর মোবাইলে টকটাইম কেনা হয় ৬৬৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে ব্যক্তির হিসাব থেকে আরেক ব্যক্তির হিসাবে পাঁচ হাজার ৭৩ কোটি ৭০ টাকা পাঠানো হয়। একই সময় কর্মীদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় ৬১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ হয় ২৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকার। আর মোবাইলে টকটাইম কেনা হয় ৩৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাস তথা অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক বেড়েছে ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৪৯ জন। গত জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ছিলো মোট ১০ কোটি ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৮৩১ জন। আর অক্টোবর শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৮১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০ জন। অর্থাৎ দেশে সার্বিকভাবে মোবাইলে লেনদেন ও গ্রাহক দিনদিন বাড়ছে।

সার্বিক বিষয়ে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম শেয়ারবাজার নিউজকে বলেন, করোনার সময় শারীরিকভাবে দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করা বা বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি বিলগুলো (বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস) জমা দেওয়া কিংবা ব্যাংকে গিয়ে লেনদেন করা অথবা মোবাইল রিচার্জ বা স্কুল কলেজের ফি পরিশোধ এসব কাজগুলো সরাসরি বাইরে গিয়ে করার সুযোগ ছিল না। যে কারণে সবাই সে সময় মোবাইল ব্যাংকিংকেই বেছে নেয়। এছাড়া সরকারের সে সময় গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ভাতাগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিয়েছিলো। অনেক কোম্পানি ওই সময় তাদের শ্রমিকদের বেতনগুলোও দিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। এই সার্বিক বিষয়গুলোর কারণে মানুষের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পরিচিতি তৈরির পাশাপাশি এক ধরণের অভ্যাস তৈরি হয়েছে। আগে গ্রাহকরা যেখানে সপ্তাহে একবার বা দু’বার মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করত এখন দিনে দুই-তিনবার ব্যবহার করছে।

এছাড়া বিকাশের মত বড় এমএফএস কোম্পানি ৩১টি ব্যাংকের সাথে সংযুক্ত সেবা চালু করে ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবা নেয়ার সুযোগ করে দেওয়ার কারণেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলে মনে করেন বিকাশের এই কর্মকর্তা।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.