বীচ হ্যাচারীর উৎপাদন বন্ধ: মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন
শেয়ারবাজার রিপোর্ট: মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ না করেই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের বীচ হ্যাচারি লিমিটেড। এছাড়াও অর্থবছর শেষ হয়ে যাওয়ার ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখনো বোর্ড সভা ডাকেনি কোম্পানি কতৃপক্ষ। ফলে প্রাপ্য ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
সিকিউরিটিজ আইনে কোম্পানির “উৎপাদনকে” সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুল্য সংবেদনশীল তথ্য হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন প্রকার নোটিশ প্রকাশ ছাড়াই উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি গোপন করে কোম্পানির লোকজনই শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে বলে অভিযোগ করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আর বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ কোম্পানিটি তাদের ডিভিডেন্ড না দিয়ে লভ্যাংশের টাকা ব্যাংকে রেখে পকেট পুরছেন পরিচালকরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কোম্পানির সর্বশেষ অর্থবছর ও হিসাব সম্পন্ন হবার ৬ মাস পার হয়ে গেলেও ডিভিডেন্ড দিতে নানা টালবাহানা করছে পর্ষদ। ডিসেম্বরে হিসাব শেষ হওয়া কোম্পানিগুলো ৬-৭ মাস পরে বোর্ড সভায় ডিভিডেন্ডের ঘোষণা করলেও বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করছে আরও দেড় থেকে দুই মাস পরে। এতে করে সারা বছরের লাভের টাকা ৮ থেকে ৯ মাস ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা হচ্ছে। আর এজিএম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই এ ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের হাতে পৌঁছায় না। এ কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরি করে এজিএম করে লাভের পাল্লা ভারি করে থাকেন পরিচালকরা।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, উৎপাদন বন্ধ থাকা সময়ের লোকসান পোষাতে এ ধরনের নানা জালিয়াতি করছে পরিচালকরা।
এছাড়াও সিকিউরিটিজ আইনে বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলেও প্রথম প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না কোম্পানিটি। এতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনার অমান্য করা হচ্ছে। অন্যদিকে সঠিক সময়ে কোম্পানির আয়-ব্যয়,মুনাফা ইত্যাদি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের জানানো হচ্ছে না। এতে অল্পকিছু লোকের ফায়দা হাসিল হলেও বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীদের তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শুধু প্রান্তিক প্রতিবেদন সময়মত প্রকাশ না করার কারণেই শাস্তির মুখোমুখি হবার কথা বীচ হ্যাচারীরর পরিচালকদের।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিএসইসির জারি করা নোটিফিকেশনের ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য ইস্যুয়ার কোম্পানিকে তাদের প্রথম প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন ৪৫ দিন এবং তৃতীয় প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হবে। অন্যদিকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম প্রান্তিক ৯০ দিন এবং তৃতীয় প্রান্তিক ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হবে।
কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পর হিসাব বছর শেষ হওয়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ।
উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করেই এর শেয়ার দর সন্দেহজনকভাবে এবং অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। এর আগে বীচ হ্যাচারীর কাছে অস্বাভাবিকহারে শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানতে চায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। জবাবে দর বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২ আগস্ট থেকে টানা তিন কার্যদিবস অস্বাভাবিকহারে বাড়ছে এ কোম্পানির শেয়ার দর। গত ২ আগস্ট এ শেয়ারের দর ছিল ১৮.০০ টাকা। মাত্র তিন কার্যদিবসের মধ্যেই ৫ আগস্ট এ শেয়ারের লেনদেন হয়েছে ২৩.১০ টাকায়। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৫.১০ টাকা।
এই বিষয়ে কোম্পানির সেক্রেটারি মো: নুরুল ইসলাম শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমকে জানান, বর্ষাকালে পানির লবনাক্ততা কমে যাওয়ার কারণে পোনা উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই এই ঋতুতে আমরা পোনা উৎপাদন বন্ধ রাখি।
তাহলে কোম্পানি এই সময়ে মুনাফা কিভাবে দেখায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা কক্সবাজার ছাড়াও অন্য একটি প্রজেক্টে কাজ করি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি বীচ হ্যাচারি বা এটির সাবসিডিয়ারি কোনো কোম্পানিরই নয়। বাইরের একটি কোম্পানির প্রজেক্ট।
তাহলে এই প্রজেক্টের মুনাফা বীচ হ্যাচারিতে দেখানো হয় কিভাবে এমন প্রশ্নে কোম্পানি সচিব কোনো উত্তর দেননি। এ বিষয়ে তিনি প্রয়োজনে এমডি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু এমডি মহোদয়ের সাথে শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমের পক্ষ থেকে বহুবার চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। মোবাইলেও তাকে পাওয়া যায়নি আর অফিসেও তিনি সাক্ষাত দেননি।
জানা যায়, বীচ হ্যাচারি ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির অনুমোদিত মুলধন ১০০ কোটি টাকা, পরিশোধিত মূলধন ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং কোম্পানির রিজার্ভের পরিমান রয়েছে ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এদিকে তালিকাভুক্তির পর ২০০৬-৭ সালে লোকসান দেখিয়ে ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত করেছে কোম্পানিটি।
এর আগে বীচ হ্যাচারি উৎপাদন বাড়াতে রাইট শেয়ারের জন্য আবেদন করে। তবে কোম্পানির ভীত ভাল না থাকায় এবং ক্রেডিট রেটিং সম্পন্ন না থাকায় রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কামিশন (বিএসইসি)।
কোম্পানিটির মোট ৩ কোটি ৯৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৪টি শেয়ারের মধ্যে পরিচালনা পর্ষেদের কাছে রয়েছে ৩৫.০১ শতাংশ, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ১৯.৩৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৪৫.৬৪ শতাংশ শেয়ার।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু/ওহসি/সা