আজ: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১০ অক্টোবর ২০১৫, শনিবার |

kidarkar

যেভাবে হয়েছে আইএস’র উত্থান

isশেয়ারবাজার ডেস্ক: জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর উত্থান, সিরিয়া-ইরাকের বিশাল এলাকা দখল এবং বৈশ্বিক জিহাদি আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ দুই-একদিনে হয়নি। আইএস’র বেড়ে ওঠার পেছনে যোগসূত্র আছে ‘আল-কায়েদা ইন মেসোপটেমিয়া’র যারা আল-কায়েদা ইরাক (একিউআই) নামেই পরিচিত।

২০০৩ সালে হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের সাম্রাজ্য গুড়িয়ে দিয়ে ইরাক দখল করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী। ২০০৩-২০১০ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধের কারণে ইরাকে ব্যাপক রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। সাদ্দাম ও তার সাম্রাজ্য ধ্বংসের জন্য আল-কায়েদাকে ব্যাপক অস্ত্র ও ট্রেনিং দেওয়া হয় যা রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংসে আরো বেশি কার্যকর হয়েছে।

একিউআই ইরাকে খুবই শক্তিশালী হলেও একটা সময় এটি নিশ্চুপ হয়ে যায়। একিউআই’র ঢেউ এতো দ্রুত এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতো না বিশেষ করে দুটি ঘটনা না ঘটলে।

২০০৬ সালে সালাফি জিহাদি গোষ্ঠীর সাথে সুন্নি নেতাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তাদের প্রদেশগুলোতে জোর করে সন্ত্রাসী এবং চরমপন্ত্রী ঢুকিয়ে দেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ছিলো। স্থানীয় উপজাতি এবং আমেরিকানদের মধ্যে সহযোগিতার কারণে ইরাকে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

একই বছর মার্কিন হামলায় নিহত হন একিউআই’র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান আবু মুসাব আল-জারকাভি। তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে এই জঙ্গি সংগঠনের পতনের একটি বাঁক পয়েন্ট চিহ্নিত হয়। ২০১০ সালে আবু বাকার আল-বাগদাদিকে নেতা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন সময়ের শেষ হয়।

আইএস’র সামরিক অভিজ্ঞতা
ইরাকের ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে ক্ষমতা নেন বাগদাদি। সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রভাব কমানো হলেও সরকারের নীতি প্রয়োগের সুযোগ ছিলো খুব কম। প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকির নীতি নির্ধারণে অনেক বেশি ইরানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়; যা শিয়া প্রভাবাধীন বাগদাদ সরকারের বিরুদ্ধে সুন্নীদের মধ্য অগ্রগামী সেনা হিসেবে বাগদাদির প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করে।

বাগদাদীর নেতৃত্বে ইরাকের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালী বদলে যায়। ক্ষমতাচ্যুত সাদ্দাম হোসের সেনাবাহিনী থেকে অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ সদস্যদের দলে টানেন বাগদাদি। বিশেষ করে সাদ্দামের রিপাবলিকান গার্ডের সদস্যরা আইএস’র পেশাদার যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করে এবং মানুষ হত্যার একটি শক্তিশালী মেশিনে পরিণত হয়।

ইরাকের অনেক বিশ্লেষক জানান, সাবেক অন্তত ১৩ জন সেনা অফিসার নিয়ে আটটি সামরিক কাউন্সিল গঠন করেন বাগদাদি। এছাড়া সিরিয়া সংকটের কথা আঁচ করতে পেরে বেশ কিছু অভিজ্ঞ জিহাদীকেও দলে অর্ন্তভুক্ত করেন তিনি। সিরিয়া এবং ইরাকের দ্বন্দ্বর কারণেই একিউআইকে ফের শক্তিশালী করতে সমর্থ হন বাগদাদি।

আবু বাকার আল-বাগদাদী: এক রহস্যময় নেতা
আইএস নেতা আবু বাকার আল-বাগদাদির সম্পর্কে খুব কম জানা যায়। তার ব্যাপারে বাস্তবতা থেকে জনশ্রুতি আলাদা করাও কঠিন। ইরাকের অনেকেরই দাবি ইসলামিক সংস্কৃতি, ইতিহাস, শরীয়াহ ও আইন বিষয়ে বাগদাদের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন বাগদাদী। তাদের আরো দাবি, এই পণ্ডিত ব্যক্তির থিওরিই তাকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে।

নাটকীয়ভাবে জীবনের গতি পরিবর্তন হওয়া এই বাগদাদির জন্ম উত্তর বাগদাদের সামারায়। বাগদাদিকে যারা চেনেন তারা অবশ্য বলছেন, তিনি বদমেজাজী, আগ্রাসী এবং যেকোনো সময় মতাদর্শ পরিবর্তনকারী। তথাপি বাগদাদির ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য থেকে একটা জিনিস নিশ্চিত হওয়া যায়, বাগাদাদীর স্ব-মৌলবাদ ও সামরিকীকরণের দিকে তার যাত্রা এবং অগ্রসর শুরু হয় ইরাকে মার্কিনি দখল ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাককে সামরিক কারাগার বানানোর পর।

সুন্নি পদাতিক সৈনিক হিসেবে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে দুইবার আটক হয়েছিলেন বাগদাদি। উমা কুসারের ক্যাম্প বুক্কা কারাগারে বন্দিও ছিলেন বেশ কিছুদিন। বন্দি থাকা অবস্থায় জেলেই অনেক জিহাদীদের সাথে পরিচয় হয় তার। জেলে বসেই ধর্মীয় মতবাদের অনেককে নিয়ে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গঠন করেন। ক্যাম্প বুক্কায় বাগাদাদীর স্বাক্ষাত হয় সাদ্দাম হোসেনের অনেক সেনা অফিসারের সাথে। এখানে জিহাদী আর সাবেক সেনা সদস্যদের মধ্যে এক কোয়ালিশন গঠন হয়।

২০১১ সালে ইরাক থেকে যখন মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয় তখনই কাজে নেমে পড়ে আইএস। রাতারাতি তাদের সদস্য সংখ্যা ১৭ হাজার থেকে ৩২ হাজারে উন্নীত হয়। ১৯৯০ সালে যখন ইরাকি আল-কায়েদাকে অনেক শক্তিশালী মনে করা হতো তখনো এদের সংখ্যা ছিলো ১ হাজার থেকে ৩ হাজারের মধ্যে। সেসময় যাদের জিহাদি বা কাছের শত্রু বলা হতো সেই বৈচিত্রময় জিহাদি বা কাছের শত্রুরাই আজ ‘আইএস’।

জিদাহিদের অর্ন্তদ্বন্দ্ব
জিহাদিদের একত্রিত করতে ২০১১ সালে আবু মোহাম্মেদ আল-জুলাইনিকে সিরিয়ায় পাঠান বাগদাদি। সেখানে জিহাদিদের নিয়ন্ত্রণ করতো আল-নুসরা ফ্রন্ট ও আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় কমিটি। সিরিয়ান জিহাদিরা একত্রিত হওয়ায় অস্ত্র, জনবল, অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধে হয়। সিরিয়া সরকারের রাজনৈতিক কৌশল এবং সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম জিহাদিদের জন্য প্রেরণা এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু ২০১৩ সালে বাগদাদী যখন ইরাক এবং সিরিয়াকে নিয়ে ইসলাসিক স্টেট ঘোষণা করেন তখন ইরাকি আল-কায়েদা এবং সিরিয়ার আল-নুসরা ফ্রন্টের মধ্যকার এই ঐক্যে ফাটল ধরে। আল-কায়েদার প্রধান নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন জুলিয়ানি। শুরু হয় আইএস-আল-কায়েদার অর্ন্তদ্বন্দ্ব। এই যুদ্ধে দু’গ্রুপেরই অনেক প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নিহত হয় এবং বাগদাদি-জাওয়াহিরির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বর্তমানে আল-কায়েদার জায়গায় আইএস বিশ্বব্যাপী ইসলামি রাষ্ট্রগঠনে জিহাদি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে।

সামাজিক অধ:পতন
আইএস দরিদ্র, গ্রামীণ সুন্নি সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিজে মিশে একটি ক্ষমতাশালী সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। রাজনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতির কারণে ইরাক এবং সিরিয়ায় ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে। যার কারণে দরিদ্র মানুষ এবং তরুণ প্রজন্ম হতাশ। আইএস বেছে বেছে এই দরিদ্র ও হতাশ তরুণদের টার্গেট করেছে। তারা ইরাকের জনবহুল মসুল ও রাক্কা শহর দখল করে সৈন্য এবং পুলিশ সদস্যকে দলে টেনেছে। এসব সদস্যদের তারা অস্ত্র, বেতন দিচ্ছে। এমনকি তেলের খনি দখল করে তার নিয়ন্ত্রণ দিচ্ছে।

এই গ্রুপ সেনা ও পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় দরিদ্র সুন্নিদের দিকে নজর দিয়েছে। তাদের নিয়ে একটি অর্থনৈতিক ভিত তৈরি করেছে। তেল ব্যবসার পাশাপাশি পূর্ব সিরিয়ার সাথে চোরাচালানিও করছে। সুন্নি-শিয়া সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে আরো অনেক কিছু চলছে যেগুলো আমরা আপাত দৃষ্টিতে দেখছি না। এখানে একটি আর্থ-সামাজিক যুদ্ধও চলছে। আরব বসন্তের অন্তরালে কৃষিভিত্তিক ও শহুরে দরিদ্রদের একটি শ্রেণীর উত্থান হয়েছে।

আইএস’র শক্তি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে প্রান্তিক জনগণ। এসব নাগরিকের মৌলিক চাহিদার সুরাহা করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এর মধ্যেই আরব বিশ্বসহ সারা দুনিয়া থেকে জিহাদিরা আইএসে যোগ দিয়ে তার কিলিং মেশিনকে আরো শক্তিশালী করছে।

আইএসের হতাশা
তবে বাগদাদীর ধারণা প্রসূত আইএস’র চেয়ে বর্তমান আইএস অনেক বেশি ভঙ্গুর। বাগাদাদীর খেলাফত গঠনের ডাকে ইসলামের মূল ধারার তেমন কেউই সাড়া দেয়নি। অনেক জিহাদি গোষ্ঠীও তার ডাক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিছু সংখ্যক লোক দলে টেনে নিজেদের জয়ের কথা বললেও প্রায় অধিকাংশ মুসলিম জনগণই তাদের বিরুদ্ধে। ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী মতবাদের কারণে সামনে চলার পথে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আইএস। সামাজিকভাবেও তারা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে।

আইএস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া
অনেক উপজাতীয় নেতারা জানিয়েছেন, তাদের ছেলে-মেয়েরা ইসলামিক আদর্শের কারণে আইএসে যোগ দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা এবং ইরাক ও সিরিয়া সরকারের অতিবেশী ইরান ঘেঁষার কারণেই তারা যোগ দিচ্ছে। এসব যুবকরা শিয়া এবং মার্কিন স্বার্থের উপর আত্মঘাতী সহ অন্যান্য হামলা চালাচ্ছে। তারা মনে করে, ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে তাদের দেশকে কলোনিতে পরিণত করেছে।

ইসলামিক আদর্শ ধারণ না করেও তাই অনেক সুন্নি যুবক আইএসের ছাতার নিচে থেকে যুদ্ধ করছে। আইএস আসলে দশকের পর দশক ধরে কিছু স্বার্থগোষ্ঠিল উদ্দেশ্যমূলক, মতাদর্শিক ও সামাজিক মেরুকরণের জেরে সৃ্ষ্ট একটি সংগঠন।

 

শেয়ারবাজারনিউজ/অ

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.