বাংলাদেশ ব্যাংক সুদৃষ্টি দিলেই পুঁজিবাজার গতিশীল হবে
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু সিদ্ধান্ত দায়ী– একথা বাজার সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার মনেই যেন গেঁথে রয়েছে। পূর্বের ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট, ১৯৯১ অনুযায়ী বান্যিজ্যিক ব্যাংকসমূহ আমানত বা দায়ের ১০ শতাংশ পরিমাণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারতো। আর এই ১০ শতাংশের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে গড়ে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অতিলোভে ২০১০ সালে কতিপয় ব্যাংক ৩০ শতাংশেরও বেশি আগ্রাসী বিনিয়োগ করে বাজারকে অতিমূল্যায়িত করে তোলে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ তদারকির অভাব ছিল লক্ষণীয়। পরবর্তীতে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পারলো তখন কৌশলগতভাবে না এগিয়ে অনেকটা আকস্মিকভাবে উক্ত অতিমাত্রার বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেয় যার নেতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়ে।
অন্যদিকে, ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংক কোম্পানির মোট এক্সপোজার উহার আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন আর্নিংয়ের মোট পরিমানের ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
অর্থাৎ এ আইন সংশোধনের ফলে, যে ব্যাংক পূর্বে গড়ে এক হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারতো সে ব্যাংক বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। পরিণতিতে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় যা এখনো চলছে। সে অবস্থান থেকে উত্তোরণের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও তা খুব বেশি উপকারে আসেনি।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার জন্য অনেক সার্কুলার জারি করেছে। তার মধ্যে ২০১০ সালের ডিওএস সার্কুলার নং- ৪ এবং ২০১১ সালের ডিওএস সার্কুলার নং-৪ এর উল্লেখযোগ্য অংশ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিওএস সার্কুলার নং-৪ এর উল্লেখযোগ্য অংশ:
(০১) পৃথক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন ব্যাতিরেকে ০১.১০.২০১০ তারিখ থেকে কোনো ব্যাংক কোম্পানি সরাসরি মার্চেন্ট ব্যাংকিং বা ব্রোকারেজ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
(০২) পুঁজিবাজারে কোনো ব্যাংক কোম্পানির মোট এক্সপোজার ওই ব্যাংক কোম্পানির মোট দায়ের ১০ শতাংশের বেশি হবে না।
(০৩) পুঁজিবাজারে কোনো ব্যাংক কোম্পানির মোট এক্সপোজার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্তা উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে না।
ক. নিজস্ব সাবসিডিয়ারিতে প্রদত্ত মূলধন
২০১১ সালের মার্চেন্ট ব্যাংকের ডিওএস সার্কুলার নং-৪ এর উল্লেখযোগ্য অংশ:
(১)ক. মার্চেন্ট ব্যাংকিং বা ব্রোকারেজ কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে গঠিত ব্যাংকের নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে উক্ত ব্যাংক কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত মূলধন ওই ব্যাংকের পুঁজিবাজার এক্সপোজার হিসাবায়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
খ. কোনো কোম্পানিতে কোনো ব্যাংক কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদি ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট উক্ত ব্যাংক কোম্পানি পুঁজিবাজার এক্সপোজার হিসাবায়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক সকল প্রকার শেয়ারকে (তালিকাভুক্ত, অ-তালিকাভুক্ত, অবসায়নযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার, প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি) এক্সপোজারের আওতায় গণনা করছে। যে সকল শেয়ার বাজারমূল্য বা গতি প্রভাবিত করেনা এমন শেয়ারকে পুঁজিবাজার এক্সপোজার এর মধ্যে গণনা করছে এ ধরনের এক্সপোজার গণনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই ধরনের এক্সপোজার গণনা করা থেকে অ-তালিকাভুক্ত শেয়ার ও দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ বাদ দেয়া হলে বাজারে ইতিবাচক ধারা ফিরে আসবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু ব্যাংকিং আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে উপরোক্ত ধারা প্রবর্তণ করে। যার ফলে পুঁজিবাজার আরো নিম্নমুখী হয়ে পড়ে এবং বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাতে বসেছে। এই আইন পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকসমূহ চাপের মুখে পড়ে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত এক্সপোজার ছিল যা আগামী ২১/০৭/২০১৬ তারিখের মধ্যে সমন্বয় করতে হতো। তাই বিনিয়োগকারীরা মনস্ত্বাত্বিক চাপে আছে এবং বাজার বিমুখ হয়ে পড়ছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং আইন এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিসমূহের প্রদত্ত মূলধন ব্যাংকের এক্সপোজার থেকে বাদ দিয়েছে যার ফলে অতিরিক্ত এক্সপোজার বেশিরভাগ ব্যাংকের সমন্বয় হয়েছে। বর্তমানে ১৫০০ থেকে ২০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ব্যাংক শুধুমাত্র বিনিয়োগ সমন্বয় করেছে কিন্তু তারা বাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই ব্যাংকসমূহের ক্ষতি কিছুটা লাঘব করা ও বাজারকে সক্রিয় করার জন্য ব্যাংকসমূহকে ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকা করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে দেয়া উচিত বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বাজারকে সক্রিয় বা ইতিবাচক ধারায় নেয়ার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়াদি জরুরী ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজনঃ
১. পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসাব (এক্সপোজার) শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত শেয়ারের ভিত্তিতে হিসাব করা।
২. দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ এক্সপোজার থেকে বাদ দেয়া।
৩. অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা।
তাহলে এ অতিরিক্ত বিনিয়োগ সয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় হয়ে যাবে এবং বাজারে বিক্রির চাপ আসবে না এবং বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
উপরোক্ত সংশোধনী বা সংযোজনী বিবেচনা করা হলে বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে এবং ভবিষ্যতে সঠিক তদারকি বলবৎ থাকলে আর কোনো প্রকার জটিলতার সম্ভাবনা থাকবে না।
আরও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছা করলেই ব্যাংক–কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী নিম্ন বর্নিত ধারার ক্ষমতা বলে প্রয়োজনীয় শিথিলতা প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারেঃ
ব্যাংক- কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ১২১ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারের সহিত পরামর্শক্রমে সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপণ দ্বারা, ঘোষণা করিতে পারে যে, এই আইনের সকল বা কোনো বিশেষ বিধান, কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানি বা সকল ব্যাংক-কোম্পানির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বা প্রজ্ঞাপণে নির্ধারিত কোনো মেয়াদকালে প্রযোজ্য হইবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ দানের ক্ষমতা প্রসঙ্গে একই আইনের ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে,
১. বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে,
ক. জনস্বার্থে বা
খ. মুদ্রানীতি এবং ব্যাংক নীতির উন্নতি বিধানের জন্য, বা
গ. কোনো ব্যাংক কোম্পানির আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী বা ব্যাংক কোম্পানির স্বার্থের পক্ষ্যে ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য, বা
ঘ. কোনো ব্যাংক কোম্পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য, সাধারণভাবে সকল ব্যাংক কোম্পানিকে অথবা বিশেষ কোনো ব্যাংক কোম্পানিকে নির্দেশ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ নির্দেশ জারি করিতে পারিবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।
(০২) বাংলাদেশ ব্যাংক স্বেচ্ছায় অথবা উহার নিকট পেশকৃত কোনো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপধারা-১ এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ বাতিল বা পরিবর্তন করিতে পারিবে এবং এরুপ বাতিলকরণ বা পরিবর্তন শর্তসাপেক্ষে হইতে পারিবে।
(০৩) উপধারা ০১ ও ০২ এর বিধানাবলী সরকারি মালিকাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকসহ সকল ব্যাংক কোম্পানির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযো্জ্য হইবে।
অর্থনীতিবিদদের সাথে বাজার বিশেষজ্ঞরাও একই মত পোষণ করে জানান, শিল্পায়নে তথা দেশের উন্নয়নে পুঁজিবাজারের অবদান উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছরই নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে উৎপাদনমুখী কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে স্ফীত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে তাদের পুঁজিবাজার বর্তমানে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও সেই অনুযায়ী আমাদের দেশের পুঁজিবাজার উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি। এর মূল কারণ হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে টাল-মাটাল পরিস্থিতি বিরাজমান।
বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মতামত বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছা করলেই পুঁজিবাজারকে গতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারে। আর এজন্য প্রয়োজন বাজার উপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া। যেমন:
১) পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসাব শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত শেয়ার গণণা করা।
২) দীর্ঘমেয়াদী ও কৌশলগত বিনিয়োগ এক্সপোজার থেকে বাদ দেয়া।
উপরোক্ত বিষয়ে শিথিলতার জন্য আইনের কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন নাই, বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছা করলেই তা পারেন। আইনে তাদের ক্ষমতা দেয়া আছে। দেশের স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার খুবই জরুরি। তাই বাজার উপযোগী এসকল সিদ্ধান্ত নেয়া হলে পুঁজিবাজার প্রাণ ফিরে পাবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সুসংঘত ও স্বনির্ভর করবে।