ইটিএফে সম্পদ ব্যবস্থাপকের বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক
শেয়ারবাজার ডেস্ক: তহবিল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের জন্য সংশ্লিষ্ট এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইটিএফ বিধিমালার খসড়ায় ফান্ড পরিচালনায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের জন্য ন্যূনতম ৩ শতাংশ বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর এ ধরনের ফান্ডে শুরুতে উদ্যোক্তা অংশের বিনিয়োগ ন্যূনতম ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২৬ মে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) অনুমোদন পাওয়া ইটিএফ বিধিমালার খসড়ায় এমন বিধান রাখা হয়েছে। জনমত যাচাইয়ের পর জুন মাসের মধ্যে বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে।
প্রকাশিত ইটিএফ ফান্ড বিধিমালার খসড়ায় ইটিএফ তহবিলের সাইজ সর্বনিম্ন ৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য অনুমোদিত অংশগ্রহণকারীদের (অথরাইজড পার্টিসিপেন্ট) মাধ্যমে ফান্ডের আকার বাড়ানো বা কমানো যাবে। অনুমোদিত অংশগ্রহণকারী বলতে বিএসইসিতে নিবন্ধিত স্টক ব্রোকার ও স্টক ডিলারদের বোঝানো হয়েছে।
ইটিএফ ফান্ডের মোট সাইজের অন্তত ১০ শতাংশ উদ্যোক্তা অংশের থাকতে হবে এবং ফান্ডের সাইজের ন্যূনতম ৩ শতাংশ বিনিয়োগ সবসময় থাকতে হবে। এছাড়া ফান্ডের টার্গেট সাইজের অন্তত ৩ শতাংশ বিনিয়োগ থাকতে হবে সম্পদ ব্যবস্থাপকের। সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ইটিএফ ফান্ডের উদ্যোক্তা হলেও প্রতিষ্ঠানটিকে এ বিনিয়োগ করতে হবে। ফান্ডটি তালিকাভুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছরের জন্য উদ্যোক্তা ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অংশ লকইন থাকবে।
এ ফান্ডে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরাও বিনিয়োগ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে ন্যূনতম ২ কোটি টাকা আয় রয়েছে, এমন ব্যক্তিই ইটিএফ ফান্ডে বিনিয়োগের যোগ্য হবেন।
ইটিএফ বিধিমালার খসড়া অনুযায়ী, ইটিএফ ফান্ড থেকে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা যাবে না। অবশ্য মিউচুয়াল ফান্ডের মতো মুনাফার অর্থ পুনর্বিনিয়োগ করতে পারবেন তারা।
প্রাথমিকভাবে ইটিএফ ফান্ডের চাঁদা সংগ্রহ করা হবে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। ইটিএফ ফান্ডের নিবন্ধন নেয়ার ছয় মাসের মধ্যে টার্গেট সাইজের অন্তত ৫০ শতাংশ পূরণে ব্যর্থ হলে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হবে।
ইটিএফ বাজারে শুধু বড় ব্লক (৫০ হাজার শেয়ারে ব্লক হতে পারে) ইস্যু করতে পারবে, যা ‘ক্রিয়েশন ইউনিট’ নামে পরিচিত। সাধারণত ব্যাংক, ব্রোকার-ডিলার, পেশাদার ট্রেডিং হাউজ, ইনস্টিটিউশনাল ফার্ম বা বিশেষজ্ঞ দ্বারা অনুমোদিত অংশগ্রহণকারীরা ম্যাচিং পোর্টফোলিও (ইটিএফে যে পোর্টফোলিও প্রতিফলিত হয়) বিনিময়ের মাধ্যমে ইটিএফের ক্রিয়েশন ইউনিট নিতে পারবেন। আবার নগদ অর্থেও ইটিএফ ফান্ডের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা যাবে। তবে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নগদ অর্থে সংগৃহীত চাঁদার পরিমাণ কোনোভাবেই ৫০ শতাংশের বেশি হবে না।
উল্লেখ্য, মনোনীত স্টক ব্রোকার-ডিলাররা যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নগদ অর্থে চাঁদা সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে সংগৃহীত নগদ অর্থ নির্ধারিত সূচক উপাদানগুলো কিংবা সিকিউরিটিজে রূপান্তর করে ইটিএফ ফান্ডে পাঠাতে হবে স্টক ব্রোকার-ডিলারদের।
ইটিএফ ফান্ডের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) প্রক্রিয়া প্রাইভেট প্লেসমেন্ট অথবা প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ও আইপিও সংমিশ্রণে করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রথমে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ফান্ডের টার্গেট সাইজের অন্তত ৫০ শতাংশ পূরণের পর আইপিওর আবেদন করতে পারবে ইটিএফ। এর পর ইটিএফ ও মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা অনুসরণ করে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান খসড়া প্রসপেক্টাস ও প্রসপেক্টাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণসহ আইপিও আবেদন জানাবে কমিশনে। আইপিওতে ইটিএফ ফান্ডে চাঁদা সংগ্রহে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫ সহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন অনুসরণ করবেন সম্পদ ব্যবস্থাপক।
প্রসঙ্গত, ইটিএফ এক প্রকার বেমেয়াদি (ওপেন-এন্ড) সমষ্টিগত বিনিয়োগ তহবিল। তবে বেমেয়াদি হলেও এসব ফান্ডের ইউনিট সেকেন্ডারি বাজারে কেনাবেচা সম্ভব। প্রথাগত বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড সাধারণত শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় না। এছাড়া প্রথাগত মিউচুয়াল ফান্ড থেকে তালিকাভুক্ত-তালিকাবহির্ভূত যেকোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা যায়। অন্যদিকে ইটিএফ কেবল শেয়ারবাজারের সূচক, সূচকভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বা পূর্বনির্দিষ্ট খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারে।
দেশীয় শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্যই এ ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের উদ্যোক্তা বা সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফান্ড নিয়ে এ ধরনের ফান্ড চালু করতে পারবেন। নির্দিষ্ট সূচকে থাকা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগনির্ভর ফান্ড হওয়ায় এতে সূচকের গতি-প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। সাধারণত যেসব বিনিয়োগকারী নির্ধারিত সূচকে অন্তর্ভুক্ত সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চান, কিন্তু সক্ষমতা নেই এবং যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী পোর্টফোলিও খরচ কমাতে চান, তারাই ইটিএফ ফান্ডের শেয়ারের ক্রেতা।
ক্রিয়েশন ইউনিট কেনার পর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এর পৃথকীকরণ করতে পারবেন এবং সেগুলো সেকেন্ডারি বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ক্রিয়েশন ইউনিটের আকার-সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়গুলো প্রসপেক্টাসে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। এছাড়া ইটিএফ শুধু প্রসপেক্টাসে উল্লিখিত নির্ধারিত সূচকে অন্তর্ভুক্ত সিকিউরিটিজেই বিনিয়োগ করতে পারবে। প্রথা অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জ তার সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানির তালিকায় কোনো পরিবর্তনের বিষয়টি আগেই ফান্ডকে জানিয়ে দেবে।
জানা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্টক এক্সচেঞ্জের নির্দিষ্ট সূচক, সূচকভুক্ত কোম্পানি কিংবা নির্দিষ্ট খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের লক্ষ্যে দেড় বছর ধরে এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড চালু করতে যৌথভাবে কাজ করছে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। উন্নততর ট্রেডিং প্লাটফর্ম চালুর পর ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে ইটিএফ চালুর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয় ডিএসই।
বিদ্যমান মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালার আওতায় বিশেষ ধরনের এ সামষ্টিক তহবিল চালু বা পরিচালনা সম্ভব না হওয়ার কারণেই আলাদা বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ বিশ্বের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের সংঘ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসসিও) সিদ্ধান্ত অনুসারে, ইটিএফ ও মিউচুয়াল ফান্ডের মতো অন্যান্য সমষ্টিগত বিনিয়োগ তহবিলের (সিআইএস) জন্য আলাদা বিধিমালা থাকতে হবে সদস্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। রোডম্যাপ অনুযায়ী চলতি বছরের ২২ জুনের মধ্যে ইটিএফ চালুর পরিকল্পনা ছিল বিএসইসির। তবে এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না থাকায় গত মার্চে অর্থ মন্ত্রণালয় অসন্তোষ প্রকাশ করে। এর পরই ইটিএফ বিধিমালাটি তৈরির উদ্যোগ নেয় কমিশন।
শেয়ারবাজারনিউজ/আ