ঋণ দিয়ে বিপাকে ২৫ কোম্পানি
শেয়ারবাজার রিপোর্ট: দেশের প্রথম মুঠোফোন অপারেটর প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড বা সিটিসেলকে আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে ২৫টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ঋণ তথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এমন তথ্য উঠে এসেছে।
আদালতের আদেশে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সিটিসেল টিকে থাকার সুযোগ পেলেও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বকেয়া ঋণ আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সিআইবি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সুদসহ সিটিসেলের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো হলো- এবি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, কমার্স ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটিব্যাংক এনএ, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এছাড়া চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ২৯৩ কোটি টাকা। বকেয়া আদায়ে সিটিসেলের অবসায়ন (ওয়াইন্ডিং আপ) চেয়ে হাইকোর্টে গত বছর একটি মামলাও করেছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
সিআইবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিটিসেলের নগদ ঋণের (ফান্ডেড) পরিমাণ ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। আর ননফান্ডেড (ঋণসুবিধা) ঋণের পরিমাণ ৬৬২ কোটি টাকা। ফান্ডেড-ননফান্ডেড দুই ধরনের ঋণের একটি বড় অংশের ওপর আবার আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। এ জন্য পাওনা আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ব্যাংকগুলো।
সিটিসেলের ঋণের বড় অংশের সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার জানান, ‘সিটিসেলের ঋণ নিয়ে আমরা সমস্যার মধ্যে আছি। এ বিষয়ে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর অর্থ আদায়ে আইনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে জানা গেছে, আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে সিটিসেলের সম্পত্তি বন্ধক থাকলেও তারাও টাকা তোলার জন্য আদালতের রায়ের অপেক্ষায় আছে। আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরই তারা অর্থ তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ৪৭৭ কোটি বকেয়ার দুই-তৃতীয়াংশ ৩১৮ কোটি টাকা ১৭ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধ করতে সিটিসেলকে সময় বেঁধে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। বাকি এক-তৃতীয়াংশ বকেয়া অর্থও ১৭ নভেম্বরের মধ্যে শোধ করতে হবে অপারেটরটিকে।
বিটিআরসির ৪৭৭ কোটি টাকার বকেয়ার মধ্যে টুজি লাইসেন্সের তরঙ্গ বরাদ্দ ও নবায়ন ফি বাবদ পাওনার পরিমাণ ২২৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজস্ব ভাগাভাগি বাবদ ২৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, বার্ষিক তরঙ্গ ফি ২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের ৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা, বার্ষিক লাইসেন্স ফি ১০ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ৩৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং বিলম্ব ফি বাবদ ১৩৫ কোটি ৭ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতিদিন সিটিসেলের কাছে কমিশনের ১৮ লাখ টাকা করে বকেয়া হচ্ছে। আদালত সিটিসেলকে এ অর্থও পরিশোধ করার আদেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহবুব চৌধুরী জানায়, ‘আদালত-নির্দেশিত বকেয়া পরিশোধে আমরা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। এর পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগকারী খোঁজার কাজও অব্যাহত আছে।’
এদিকে গত ৩১ জুলাই সিটিসেলের গ্রাহকদের বিকল্প সেবা নেওয়ার জন্য একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে বিটিআরসি। ওই বিজ্ঞপ্তিতে গ্রাহকদের ১৬ আগস্টের মধ্যে বিকল্প সেবা নেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়, যা পরে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বিটিআরসির গণবিজ্ঞপ্তি সিটিসেলের আয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে উল্লেখ করে মেহবুব চৌধুরী বলেন, এ বিজ্ঞপ্তির পর বেশির ভাগ গ্রাহকই চলে গেছেন।
বিটিআরসির সর্বশেষ জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিটিসেলের গ্রাহকসংখ্যা ৬ লাখ ৬৮ হাজার। তবে এখন সেটি ১ লাখের নিচে চলে এসেছে বলে বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে। গ্রাহকের পাশাপাশি কমছে অপারেটরটির চালু থাকা টাওয়ারের সংখ্যাও। কাগজে-কলমে সিটিসেলের টাওয়ারের সংখ্যা ৮৫০-এর বেশি বলা হলেও বর্তমানে চালু থাকা টাওয়ারের সংখ্যা ২০০-এর কম বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, দেশের প্রথম মুঠোফোন অপারেটর সিটিসেল ১৯৯৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে। অপারেটরটির বর্তমানে ৫৫ ভাগ শেয়ারের মালিক দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী প্যাসিফিক মোটরস ও ফার ইস্ট টেলিকম। এর মধ্যে প্যাসিফিক মোটরসের শেয়ারের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর ফার ইস্ট টেলিকমের ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিংটেল। প্যাসিফিক মোটরস ও ফার ইস্ট টেলিকমের কর্ণধার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা মোরশেদ খান।
শেয়ারবাজারনিউজ/এম.আর