মন্দা ভাব কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে হবে- মো: কবির হোসেন।
শেয়ারবাজার রিপোর্ট: মো: কবির হোসেন ১৩ বছর প্রবাসে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে হংকং-এ পাঁচ বছর কোরিয়াতে আট বছর। এরপর দুবাইয়ে দুই বছর ছিলেন। অনেক কষ্ট করে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ২০০৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাকি দেয়ার ভয়ে এদিকে মন বসাতে পারলেন না। এক বন্ধুর কাছে পেলেন শেয়ার ব্যবসা করার বুদ্ধি। শেয়ারবাজারের ব্যবসা বুঝে ২০০৪ সালে মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ৩০০০ কোডে মাধ্যমে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার ব্যবসা শুরু করেণ। তার পর ধাপে ধাপে বাজারে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন। এক কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে শেয়ার ব্যবসা শুরু করে ভালোই লাভের মুখ দেখছিলেন। তবে কৌশলী হয়ে বিনিয়োগ না করায় ২০১০ সালের ধসে প্রায় সবটাই হারিয়েছেন। তবুও শেয়ার ব্যবসাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মো: কবির হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি শেয়ারবাজার নিউজ ডটকমকে এসব কথা বলেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক মো: মতিউর রহমান মুকুল। সাক্ষাতটির চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
শেয়ারবাজার নিউজ: শেয়ারবাজারে ব্যবসার শুরুটা কিভাবে হলো?
মো: কবির হোসেন: দেশে ফিরে আসি ২০০৪ সালে। কোন ব্যবসাতেই তেমন লাভ হচ্ছিলো না। পরে এক বন্ধু বলেন শেয়ার ব্যবসা বেশ লাভজনক। তখন বাজার স্বাভাবিক নিয়মে চলছিল।
শেয়ারবাজার নিউজ: শুরুতে কেমন বিনিয়োগ করেছিলেন?
মো: কবির হোসেন: বিদেশ থেকে ফিরে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। তখন বাজারের অবস্থা বেশ ভালই ছিলো লাভও ভালো হত।
শেয়ারবাজার নিউজ: এখন কি অবস্থা?
মো: কাবির হোসেন: এখন তো একেবারে পথে বসে পড়েছি। সব টাকা লোকসান হয়ে গেছে। এক কোটি টাকা থেকে এখন মাত্র ৫ লাখ টাকা আছে।
শেয়ারবাজার নিউজ: এত লোকসান কি ভাবে হলো?
মো: কবির হোসেন: ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে মহাধসের সময় লোকসান হয়। বাজারে তখন অনেক কারচুপি হয়েছে। যার কারণে আজকে বাজারের এ অবস্থা। তবে বুঝতে পারিনি বাজার এতটা খারাপ অবস্থায় চলে আসবে।
শেয়ারবাজার নিউজ: ধসের পরে কেমন বিনিয়োগ করেছেন?
মো: কবির হোসেন: ধসের সময় মনে করেছিলাম বাজার আবার উঠবে, তখন ভাইদের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ধার করলাম, জমি বিক্রি করে ১০ লাখ টাকা পেলাম। মিলিয়ে আবার ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলাম। আমি অনেক টাকা দেনা হয়া গেলাম। এখন আর কি করার সবাই পাওনা টাকা ফেরত চাইতে শুরু করে। পরবর্তীতে আমার শেষ সম্বল বাপের দেওয়া জায়গায় একটা বাড়ি করছিলাম, সে জায়গাটাও বিক্রি করে দিলাম ৩৪ লাখ টাকায়। সব দেনা শোধ করে ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল শেয়ার বাজরে এক কোটি টাকা লোকসান করেছি। এখন আমার পুঁজি মাত্র পাঁচ লাখ। নিজের বাড়ি বিক্রি করে এখন অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকছি। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি কিন্তু দুই ছেলে-মেয়ের দিকে তাকালে কান্না চলে আসে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি শেয়ার ব্যবসা করে আমার মতো অবস্থা যেন আর কারও না হয়।
শেয়ারবাজার নিউজ: এখন শেয়ার ব্যবসা কেমন চলছে?
মো: কবির হোসেন: এই বাজারে আমার যে অবস্থা হয়েছে তাতে বেশি ভাল বলার কিছু নেই। বাজার স্বাভাবিক হতে আরও অনেক সময় লাগবে। তবে আমাদের এখন যে অবস্থা হয়েছে, তার থেকে অনেক ভাল ছিলো খারাপ মানুষের হাতে গুলি খেয়ে মরাটা। এখন শেয়ার বাজার আহত হয়ে হাসপাতালের সিটে শুয়ে থাকার মত। শুধু কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যু হবার অপেক্ষা মাত্র।
শেয়ারবাজার নিউজ: বাজারে এত বড় ধস নামার কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
মো: কবির হোসেন: ধস নামার কারণ বাজারে বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না। যারা বাজার নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে রয়েছেন তারা শেয়ার বাজার নিয়ে মাথা ঘামান না। এ ব্যবসার সাথে অনেক মানুষ সরাসরি জড়িত। আমাদের পরিবার জড়িত। এটা তারা চিন্তা করেন না বরং বাজার নিয়ে উল্টা-পাল্টা কথা বলেন। ৩০০ টাকার শেয়ার এখন মাএ ৩০ টাকা। শেয়ারের দার একটু বাড়লেই, কেন বাড়ল ইনকোয়্যারি দেয়, কিন্তু ৩০০ টাকা শেয়ার দর কমে ৩০ টাকায় নেমে এসেছে এ ক্ষেত্রে ‘কেন এতটা দর কমলো’ সে বিষয়ে কোনো ইনকোয়্যারি নেই। শেয়ার দর বাড়লে যেমন কারণ জানতে চাওয়া হয়, ঠিক তেমনি কমলেও এর কারণটা যদি জানতে চাওয়া হতো, তাহলে বাজারের এ অবস্থা হতো না।
শেয়ারবাজার নিউজ: সেকেন্ডারি মার্কেটের কোম্পানিগুলো সম্পর্কে কিছু বলেন?
মো: কবির হোসেন: তালিকাভুক্ত যে সব কোম্পানির আর্থিক স্বক্ষমতা ভাল, সে সকল কোম্পানির সব দিক বিবেচনা করে বিনিয়োগ করা উচিৎ।
শেয়ারবাজার নিউজ: আইপিওতে আপনার উপস্থিতি কেমন?
মো: কবির হোসেন: আইপিও অনেক সময়ের ব্যাপার তাই এখানে আমার উপস্থিতে নেই। আমি শুধু সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করি। এখন মার্কেটের যে অবস্থা তাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। তারপরও বিএসইসি একটার পর একটা নতুন আইপিওর অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে সেকেন্ডারি মার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমার মতে, স্বল্প মুলধনী কোম্পানিগুলোকে বাজারে অনুমোদন না দিয়ে ব্যাংকমুখি করা উচিত। তাহলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ হুমকির মুখে থাকবে না।
শেয়ারবাজার নিউজ: ওটিসি মার্কেটে আপনার কোন শেয়ার রয়েছে কি?
মো: কবির হোসেন: ওটিসি মার্কেটে আমার কোন শেয়ার নেই। তবে ওটিসিতে যে সকল কোম্পানি রয়েছে তার মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানিই স্বল্প মুলধনী, উৎপাদন ক্ষমতা কম, নিজেস্ব পাওয়ার প্লান্ট থাকে না, ডিভিডেন্ড দেয় না ইত্যাদি কারণে কোম্পানিগুলোকে ওটিসিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের মত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাই আমার অনুরোধ থাকবে, এ ধরণের সমস্যা যে সকল কোম্পানির রয়েছে। সে সকল কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে অনুমোদন না দিয়ে, ব্যাংক থেকে টাকা উত্তলোনের পরামর্শ দিলে ভাল হয়। এতে আমাদের অর্থ হেফাজতে থাকবে। আর কোম্পানিগুলোর কোন সমস্যা থাকলে ব্যাংক তাকে চাপ দিয়ে টাকা নিতে পারবে, যেটা প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব না।
শেয়ারবাজার নিউজ: বর্তমান মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?
মো: কবির হোসেন: বর্তমান মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অবস্থা খুব খারাপ। যেটা কখনোই মেনে নেওয়ার মত না। অর্ধেকের বেশি ফান্ডের ইউনিট দর ফেস ভ্যালুর নিচে থাকায় এই খাত থেকে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমার মতে, যে ফান্ডগুলোর ইউনিট দর অনেক দিন ধরে ফেস ভ্যালুর নিচে রয়েছে, তাদের কাছ থেকে বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য পাওনা ফিরিয়ে দিয়ে ঐ ফান্ডগুলোকে বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।
শেয়ারবাজার নিউজ: বাজারের মন্দা ভাব কাটাতে করণীয় কি বলে মনে করেণ?
মো: কবির হোসেন: শেয়ারবাজারের মন্দা ভাব কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়ক ভুমিকা পালন করতে হবে। তার পাশাপাশি মার্চেন্ট ব্যাংক এবং বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে।
শেয়ারবাজার নিউজ: নতুন বিনিয়োগকারীদের করনীয় কি বলে মনে করেন?
মো: কবির হোসেন: নতুন বিনিয়োগকারী ভাইদের উদ্দেশ্য করে বলছি, আগে শেয়ার মার্কেট দেখেন, ভাল ভাবে বুঝেন তার পর বিনিয়োগ করেণ। অন্য কারও কথায় শেয়ারবাজারে আসবেন না বা বিনিয়োগ করবেন না। শেয়ারবাজারে বোঝার কোন শেষ নেই।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু/ও