কাগজ শিল্পে সবচেয়ে বড় অংশীদার বসুন্ধরা পেপার
শেয়ারবাজার রিপোর্ট: দেশের কাগজ ও মুদ্রণ শিল্পের সবচেয়ে বড় অংশীদার বসুন্ধরা পেপার মিলস লি: বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণ প্রস্তাবের (আইপিও) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমতি পেয়েছে। অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটির তালিকাভুক্তিতে বাজারে ভাল শেয়ারের পাশাপাশি গভীরতাও বাড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, ২৮ আগস্ট শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র ৬১০তম কমিশন সভায় বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারদর (কাট-অফ প্রাইস) নির্ধারণের জন্য বসুন্ধরা পেপারকে বিডিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি বিডিংয়ের জন্য কমিশনের কাছ থেকে সম্মতি পত্র (কনসেন্ট লেটার) পেয়েছে। উত্তোলিত অর্থ দিয়ে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয়, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও আইপিওতে খরচ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
বসুন্ধরা পেপারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বিডিং এর আয়োজনের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে আবেদন করা হয়েছে। শিগগিরই বিডিং এর তারিখ ঘোষণা করা হবে।
কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এএএ ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি: এবং রেজিস্ট্রার টু দ্যা ইস্যু হিসেবে কাজ করছে এএফসি ক্যাপিটাল এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে বসুন্ধরা পেপারের জেষ্ঠ্য নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মো: নাসিমুল হাই শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমকে বলেন, পুঁজিবাজার থেকে শুধুমাত্র টাকা উত্তোলনই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। দেশের মানুষ তথা বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে আমাদের এই অংশগ্রহণ। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে আমরা ১০ শতাংশ ট্যাক্স ছাড় পাব। এতে আমাদের ব্যবসায় মুনাফা আগের তুলনায় অনেক বাড়বে। যার ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগকারীরাও আমাদের কোম্পানি থেকে ভাল ডিভিডেন্ড পাবেন। ইতিমধ্যে আমাদের একটি কোম্পানি মেঘনা সিমেন্ট পুঁজিবাজারে রয়েছে। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে। আমরা মনে করি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে কোম্পানির স্থায়িত্ব ও গভীরতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
কোম্পানিটিকে বর্তমানে আয়ের উপর ৩৫ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির কারণে ১০ শতাংশ কর কমে ২৫ শতাংশ কর পরিশোধ করবে।
জানা যায়, বসুন্ধরা পেপার কাগজ, টিস্যু, সেনেটারি ন্যাপকিন, হ্যান্ডগ্লাভস, ব্যাগ প্রভৃতি পণ্য উৎপাদন করে। কারখানার তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে পণ্যগুলো উৎপাদন করা হয়।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএও-এসটিএটি ফরেস্ট্রি ডাটাবেজের তথ্যানুযায়ী বিশ্বব্যাপি পেপার ও পেপার বোর্ডের ব্যবসা প্রতি বছর ২.৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এমন প্রবৃদ্ধি আগামি ২০৩০ সাল পর্যন্ত থাকবে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা, শিক্ষার হার এবং জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধির কারণে কাগজের ব্যবহার বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮ হাজার কোটি টাকার কাগজের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে প্রতিমাসে ৪০০ কোটি টাকার ৬০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ দেশে উৎপাদন হয় এবং প্রতিমাসে ৪০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদিত কাগজের ৯০-৯৫ শতাংশ আসে বেসরকারি প্রায় ৪০টি কোম্পানির মাধ্যমে। এরমধ্যে ৪২.৫৬ শতাংশ কাগজ উৎপাদন করছে বসুন্ধরা পেপার মিলস লি:। বর্তমানে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার মেট্রিক টন।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানি সচিব বলেন, দেশে কাগজের বাজারে একটা বড় অংশ বসুন্ধরা পেপার মিলসের। আমাদের তৈরি কাগজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তাই উৎপাদনও বাড়াতে হচ্ছে। আর পুরো বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। তাছাড়া আমরা এখানে শুধু মুনাফার জন্য কাগজের ব্যবসা করছি না। আমাদের তৈরি কিছু নির্বাচিত পণ্যে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। যেমন ছোটদের জন্য তৈরি লেখার খাতায় আমরা ভর্তুকি দিই। এতে স্কুল ভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীরা কম মূল্যে লেখার খাতা ব্যবহার করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে বনায়নের সঙ্কটের কারণে কাগজ তৈরির কাঁচামাল পাল্প বা মন্ড বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পরিবেশের সুরক্ষার জন্য আমরা ব্যবহৃত কাগজ (ওয়েস্টেস পেপার) রিসাইকেল করে কাঁচামাল তৈরি করছি। তবে সরকার সুরক্ষা দিলে এই শিল্পের বিস্তার বাড়ানো সম্ভব। কারণ বর্তমানে কাগজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এদিকে দেশে উৎপাদিত টিস্যুর সবচেয়ে বড় যোগানদাতা বসুন্ধরা পেপার মিলস। মূলত তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে টিস্যু ব্যবসার বিকাশ ঘটেছে। মোট চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ টিস্যু বসুন্ধরা সরবরাহ করে। টিস্যুর বাজার সম্পর্কে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পণ্যটির মাসিক চাহিদা হবে ৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। বর্তমানে আমরা ১৭০০ মেট্রিক টন উৎপাদন করছি এবং প্রতিমাসে ৩০ কোটি টাকার টিস্যু বিক্রি হচ্ছে। আইপিও প্রজেক্ট সচল হলে কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৪ হাজার মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে ভারতে ৫০০ মেট্রিক টন ক্ষমতার দুটি কনভার্টিং ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা থেকে কারখানাগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
টিস্যুর বাজার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চমজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপি টিস্যুর বাজার প্রতিবছর ৪.৯০ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধির হার ১৩ শতাংশ। জিডিপি’র ০.০২৫ শতাংশ টিস্যুর বাজার। দেশে মাথাপিছু ১৪৫গ্রাম টিস্যু ব্যবহার হয়।
এ প্রসঙ্গে মো: নাসিমুল হাই বলেন, বসুন্ধরা টিস্যুর মতো স্বাস্থ্যকর পণ্য মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছে। এখনও গ্রাম পর্যায়ে অনেকে এ বিষয়ে সচেতন নয়। তাদের সচেতন করতে বিভিন্ন সভা সেমিনার হচ্ছে। এতে গ্রাম পর্যায়েও টিস্যুর চাহিদা বাড়ছে।
কোম্পানিটির রেড-হারিং প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪৩ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। কোম্পানিটির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একই খাতের হাক্কান পাল্প বিক্রি করেছে ৩০ কোটি টাকা এবং খুলনা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং পণ্য বিক্রি বাবদ আয় করেছে ১৯২ কোটি টাকা।
২০১৬-২০১৭ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি’১৭-মার্চ’১৭) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১.১২ টাকা এবং শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ৩৩.২২ টাকা। ৩০ জুন, ২০১৬ শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৩.৯৩ টাকা।
কোম্পানিটির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ১৪৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ৩০ জুন, ২০১৬ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে কোম্পানিটির মোট ৪৭৩ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ রয়েছে। এরমধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বেশি ১৬২ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। ৩০ জুন, ২০১৭ হিসাব বছর শেষে মোট মেয়াদি ঋণের পরিমাণ হবে ৩৬১ কোটি টাকা।
শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, শেয়ারবাজারে মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির চাহিদা রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট স্টেহোল্ডাররা বিভিন্ন সভা সেমিনারে দেশের ভাল কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য আহবান জানিয়েছেন। কাগজ ও মুদ্রণ খাতে বসুন্ধরা একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। বসুন্ধরা পেপার বাজারে আসায় অন্য বৃহৎ শিল্পগ্রুপ গুলোও উৎসাহিত হবে।
শেয়ারবাজারনিউজ/আ