আড়ালে বড় চক্রান্ত করছে মিয়ানমার
শেয়ারবাজার ডেস্ক: রোহিঙ্গা ইস্যুতে দৃশ্যত সুর নরম করেছে মিয়ানমার সরকার। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি। তবে এ নরম সুরে যে বক্তব্যগুলো মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের প্রতিনিধিরা দিচ্ছেন, সেগুলোর আড়ালে নানা ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধিই দেখছে বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমা দেশগুলো যখনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠক বা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বসছে, তখনই কোনো না কোনো ইতিবাচক তৎপরতা দেখানোর চেষ্টা করে মিয়ানমার। কিন্তু এর আড়ালে রোহিঙ্গা নিধন ও দেশছাড়া করা অব্যাহত রেখেছে। এর ফল হিসেবে এরই মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, হঠাৎ করেই মিয়ানমার দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে অভিহিত করা শুরু করেছে। এ নিয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ওপরই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সে জন্য আমাদের কিছুটা নতুন পথ খুঁজতে হবে। এ কারণেই আমরা আপাতত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বলছি না। একই কারণে না নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতেই প্রথমবারের মতো মিয়ানমার বলেছে যে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা ‘শরণার্থী’। হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ বানাতে মিয়ানমারের এত আগ্রহ কেন? আমরা এটি চিন্তা করছি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করলে তাদের ফেরত পাঠাতে আপাতদৃষ্টিতে সমস্যা হবে। কারণ মিয়ানমারও চাইছে একটি ফাঁদে ফেলতে। শরণার্থীবিষয়ক সনদের মূল বিষয় ছিল কাউকে জোর করে পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কাউকেই জোর করে পাঠানোর ইচ্ছাও আমাদের নেই।
গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী ইউ কিয়াও তিন্ত সুয়ে ঢাকা সফরে এসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ পোষণ করলেও ১৯৯২ সালের দুই দেশের যৌথ বিবৃতি অনুসরণের ওপর জোর দিয়েছেন। ওই যৌথ বিবৃতিতে মূলত মিয়ানমারে বসতবাড়ি বা ঠিকানার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই করার কথা বলা হয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) গত সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কেবল নির্মূল করাই নয়, তাদের ফিরে যাওয়া ঠেকানোর লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে অভিযান ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর এমনভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তাদের চিহ্নই আর না থাকে।
সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা জানান, কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জানতে পারে যে মিয়ানমার সারা বিশ্বে এমন একটি প্রচারপত্র বিলি করছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্গলি’ হিসেবে অভিহিত করে তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। এর পরপরই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে রোহিঙ্গা জাতিসত্তার বিকাশ ও তাদের সঠিক ইতিহাস প্রচার করে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন বলছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের এবং এ সমস্যার সমাধানও মিয়ানমারের হাতে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চাপে পড়লেই কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে মিয়ানমার। গত মাসের প্রথমার্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের প্রাক্কালে মিয়ানমার আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। গত মাসেই নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রকাশ্য আলোচনাকে সামনে রেখে সু চি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন।
এ সপ্তাহে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ও জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা জেফরি ফেল্টম্যানের মিয়ানমার সফরের প্রাক্কালে সু চি বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাঁর সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইইউ সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আগামী সোমবারের বৈঠকে মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তা ও বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ইতিমধ্যে মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গতকাল বলছে, রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা তদন্তে তারা কমিটি গঠন করেছে।
সুচি ও তাঁর উপদেষ্টা যখন রোহিঙ্গাদের পক্ষে অনেকটা ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছেন তখন মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করে বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের কেউ না। তাঁরা ‘বেঙ্গলি’, অর্থাৎ তত্কালীন ‘বেঙ্গল’ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে মিয়ানমারে গেছে।
গত ২৪ আগস্ট আনান কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানসহ ৮৮ দফা সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাখাইন রাজ্যে জঙ্গি হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গা নিধন ও দেশ ছাড়া করার অভিযান শুরু করে মিয়ানমার বাহিনী।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই অভিযান ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এমনকি অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগেই ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা পুরুষদের গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানের সময় মাইক ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্গলি’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের মিয়ানমার ছাড়তে বলা হয়েছে এবং এখনো তা হচ্ছে।
আনান কমিশনের প্রতিবেদন নিয়েও মিয়ানমারের কৌশল : গত মাসের প্রথমার্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে ও নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জরুরি বৈঠকের প্রাক্কালে মিয়ানমার সরকার অনেকটা তড়িঘড়ি করেই আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সুয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। জানা গেছে, ওই দুটি কমিশনের সুপারিশগুলো পরস্পরবিরোধী। তাই পরস্পরবিরোধী সুপারিশগুলো মিয়ানমার কিভাবে বাস্তবায়ন করবে সে নিয়েই কৌতূহল ছিল বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের। পরে অবশ্য মিয়ানমার সরকার বলেছে, তারা আনান কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে। তবে বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গা সংকটের প্রকৃত সমাধান চাইলে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো একসঙ্গেই বাস্তবায়ন করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ চায় না, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরে আবার ফিরে আসুক।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু