আজ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ইং, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২৪ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার |

kidarkar

শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বাউল বাড়ি যাচ্ছেন বারী সিদ্দিকি

imagesশেয়ারবাজার ডেস্ক: শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের বাউল বাড়িতে শেষ আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন বারী সিদ্দিকি। সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বারী সিদ্দিকীর প্রথম জানাজা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয় জানাজা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে। বাদ আসর তৃতীয় ও শেষ জানাজা হবে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে। এরপর বারী সিদ্দিকীকে নেত্রকোনার কারলি গ্রামে ‘বাউল বাড়ি’তে দাফন করা হবে।

নেত্রকোনা শহরে তাঁর দুটি বাড়ি, পড়ে আছে অবহেলা আর অযত্নে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে। এখানেই ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বারী সিদ্দিকী। মাত্র কদিন আগেই ছিল তাঁর জন্মদিন। কিন্তু নিজের জন্মদিন তিনি কখনোই পালন করেননি। বলতেন, ‘এগুলো ছোটদের ব্যাপার। ছোটরা করবে।’

নেত্রকোনা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে কারলি গ্রাম। এখানে ২৫০ শতক জমির ওপর তিনি গড়ে তোলেন আশ্রম, নাম ‘বাউল বাড়ি’। তাঁর ভাষায়, ‘আপনি বৃষ্টি দেখতে চান? এখানে এক তলার ছাদে বসলে চারদিকে ২ কিলোমিটার শুধু বৃষ্টি দেখতে পাবেন। রোদ দেখতে চান? ২ কিলোমিটার শুধু রোদ। কুয়াশা? তাও।’ এমনি নিরিবিলি পরিবেশে এই আশ্রম গড়েছিলেন চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। এই বাউল বাড়িতে ছোট্ট ছেলেমেয়েরা থাকবে, সংগীত চর্চা করবে, খেলাধুলা করবে, শিশু-কিশোর বান্ধব পরিবেশে তারা বড় হবে। শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।

তবে সাব্বির সিদ্দিকীকে বলে গেছেন তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা। মৃত্যুর পর এই ‘বাউল বাড়িতেই’ যেন তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ধ্রুপদ সংগীতে বারী সিদ্দিকীর তালিম নেওয়া শুরু ১২ বছর বয়সে। তালিম নিয়েছেন গোপাল দত্ত, আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ আরও অনেকের কাছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনেতে পণ্ডিত ভিজি কারনাডের কাছেও তালিম নেন। ১৯৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন।

বারী সিদ্দিকী পড়াশোনা করেছেন নেত্রকোনায় আঞ্জুমান সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক করেন। এরপর পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন সংগীতের সঙ্গে। বংশীবাদক হিসেবে তখন তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাসা থেকে বের হতেন সকাল ৯টায়, ফিরতেন রাত ১২টায়। স্টুডিও, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার কিংবা মঞ্চের অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। গান গাইতেন বাসায় কিংবা পরিচিতজনদের মাঝে।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ হাসন রাজার গান নিয়ে কাজ করছেন। রাজধানীর সাসটেইন স্টুডিওতে রেকর্ডিং হচ্ছে। এখানে বাঁশি বাজাচ্ছেন বারী সিদ্দিকী। হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সব কাজ বন্ধ। সহশিল্পীরা বারী সিদ্দিকীকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পরপর কয়েকটি বিচ্ছেদ গান গেয়েছিলেন তিনি। সেদিন বারী সিদ্দিকীর গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁকে। বারী সিদ্দিকীকে দু-একটা বিচ্ছেদ গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই রাতে ধানমন্ডিতে হুমায়ূন আহমেদের বাসায় বসার ঘরে ৩৫টা গান গেয়েছিলেন তিনি। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলেন নতুন এক মেধাবী শিল্পীর গান। অন্য রকম কণ্ঠ। কণ্ঠ দিয়ে তিনি সবাইকে পুরোটা সময় আবিষ্ট করে রেখেছিলেন। ১৯৯৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির কাজ করেন। তখন এই ছবিতে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান বারী সিদ্দিকী। এই ছবির ‘শুয়া চান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ গানগুলো বারী সিদ্দিকীকে পৌঁছে দেয় সারা দেশের মানুষের কাছে।

বারী সিদ্দিকী ১৬০টি গান গেয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি অ্যালবামের কাজ করেছেন। ১০টি গানের কথা লিখেছেন দেলোয়ার আরজুদা শরফ, সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন এবং গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন বারী সিদ্দিকী। সাব্বির বলেন, ‘কিছুদিন আগে গানগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে। বাবার অসুস্থতার কারণে কাউকে জানানো সম্ভব হয়নি।’

হুমায়ূন আহমেদ নিজের লেখা গান তাঁকে দিয়ে সুর করাতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে যখন তিনি দেশে এসেছিলেন, তখন বারী সিদ্দিকীকে একটি গান দিয়েছিলেন। গানটির স্থায়ী অংশটুকু হলো ‘কেউ গরিব অর্থের লোভে/কেউ গরিব রূপে/এই দুনিয়ায় সবাই গরিব/কান্দে চুপে চুপে…’। সম্প্রতি হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে গানটি গেয়ে শোনান তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য অ্যালবামগুলো হলো ‘অন্তর জ্বালা’, ‘দুঃখ রইল মনে’, ‘ভালোবাসার বসতবাড়ি’। গান গেয়েছেন কয়েকটি চলচ্চিত্রেও।

২০১৬ সাল থেকে সপ্তাহে তিন দিন বারী সিদ্দিকীর কিডনির ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও গানের ডাক পেলে অসুস্থতার কথা ভুলে যেতেন। সাব্বির বললেন, ‘ডায়ালাইসিস শেষে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ৭ ঘণ্টা জার্নি করে তিনি যশোর গেছেন। গাড়িতেই ঘুমিয়েছেন। মঞ্চে ওঠার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে দেখি তিনি সুস্থ। মঞ্চে গিয়ে বসলেন। এরপর কোথা দিয়ে দেড় ঘণ্টা চলে গেল, টেরই পাইনি। কেউ বুঝতেও পারেনি, তিনি কতটা অসুস্থ। গত ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এভাবেই গান করেছেন।’

বারী সিদ্দিকীকে চিকিৎসক পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসককে তিনি বললেন, ‘আমি গান গাইতে গাইতে মরতে চাই। আমার মৃত্যু যদি মঞ্চে হয়, তাহলে সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের।’

আগেই জানানো হয়েছে, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী আর নেই। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা নাগাদ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে আর অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগীত পরিচালক ও মুখ্য বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বারী সিদ্দিকী দুই বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর দুটি কিডনি অকার্যকর ছিল। তিনি বহুমূত্র রোগেও ভুগছিলেন। গত ১৭ নভেম্বর রাতে তিনি হৃদরোগে   আক্রান্ত হন। এরপর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি অচেতন ছিলেন। তাঁকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়।

বারী সিদ্দিকীর অন্যতম শিষ্য জলের গানের শিল্পী রাহুল আনন্দ বলেন, ‘গুরুজির অসম্ভব মনের জোর। অনেক দিন থেকে কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু দেখে কিংবা কথা বলে তা বোঝার উপায় ছিল না। তিনি গান গেয়ে গেছেন। এই তো সেদিন হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষেও টিভি চ্যানেলে তিনি গান গেয়েছেন, কথা বলেছেন।’

আজ শুক্রবার সকালে কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয় বারী সিদ্দিকীর গান। গান দেখছি আর বারবার মনে হচ্ছে, তাঁর মৃত্যু নেই, তাঁর গানই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বছরের পর বছর। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে যাবে তাঁর গান।

শেয়ারবাজারনিউজ/ম.সা

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.