মৃত্যুর পরে কতদিন প্রিয়জনের সঙ্গ চায় প্রেতাত্মারা
শেয়ারবাজার ডেস্ক: প্রমথনাথ বিশীর এক অসমান্য অতিলৌকিক কাহিনির নাম ‘সাথে সাথে ঘুরবে’। পড়তে বসলে আতঙ্ক ছেঁকে ধরে, এমনই গল্প এটি। কিন্তু তার চাইতেও গোলমেলে এর শিরোনাম। জীবিত মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো এক প্রেতের আখ্যান এটি। না, সেই প্রেত মায়াবি নয়, তার মধ্যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর প্রেম নেই। সে আতঙ্কের পর আতঙ্কই উপহার দেয় খালি। বাংলা হরর সাহিত্যের এই রত্নসুলভ লেখাটির সূত্রে একটা কথা বার বার ফিরে আসে, মৃত্যুর কত দিন পর পর্যন্ত মানুষের ‘সাথে সাথে’ ঘোরে প্রেতাত্মা? (যারা আত্মা-প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী নন। তারা এখানেই পড়া বন্ধ করুন। এই লেখা তাদের জন্য নয়।)
আবিশ্ব হরর সাহিত্যের একটা বড় জায়গা জুড়েই রয়েছে মায়া। ‘মায়া’, মানে মায়াই। এর কোনও খাপে খাপ ইংরেজি তরজমা হয় না। জাগতিক বন্ধন, পিছুটান ইত্যাদির সঙ্গে নিজের দেহ সংক্রান্ত সংস্কার মিলে মিশে জন্ম নেয় এই মায়া। এর বন্ধনই নাকি আটকে রাখে প্রেতাত্মাদের। এর টানেই তারা ‘তাই পারে না ছেড়ে যেতে’।
কিন্তু প্রশ্ন এই, ঠিক কতদিন এই মায়ার বাঁধন তাদের আটকে রাখে এই মরপৃথিবীতে? কবেই বা তারা ‘মুক্তি’ পায়? কী জানায় বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, কী জানান প্যারানর্মালবাদীরা?
হিন্দুদের পারলৌকিক ক্রিয়া সাধারণত সম্পন্ন হয় ১০ বা ১৩ দিনে। ইসলাম ধর্মমতে ৪০ দিন পরে সম্পন্ন হয় পারলৌকিক কাজ। খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী কবরস্থ হওয়ার প্রাক্কালে সম্পন্ন হয় সমবেত প্রার্থনা। সেখানে শোক পালনের সময়কালটি একান্ত ভাবেই ব্যক্তিগত। প্রায় প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে স্মরণ-ভোজ বা ফিউনেরাল ফিস্ট। এটা মৃতকে অসম্মান করার জন্য নয়, তার আত্মাকে তৃপ্ত করার প্রতীক হিসেবেই আয়োজিত হয়।
কেন এই শোকপালন? জীবিত নিকটজন শোক পালন করলেই কি আত্মা মায়ামুক্ত হয়? এর কোনও উত্তর আমাদের কাছে নেই। তবু অনুমান করা যায়, শোক পালনের এই সময়কালটি নির্দিষ্ট হয় আত্মাকে এটুকু বোঝানোর উদ্দেশ্যে যে, সে বিগত।
পরলোক বিশেষজ্ঞরা জানান, সেই বিদেহী আত্মাই তার নিকটজনের কাছে ঘোরাফেরা করে, যারা নিজের মৃত্যুকে টের পায়নি। বিশ্বাস করতে পারেনি, সে ইহলোক ত্যাগ করেছে। পরলোক বিশেষজ্ঞরা বিবিধ অ্যাস্ট্রাল প্লেনের কথা বলেন। আত্মা সেই সব স্তর পরিভ্রমণ করে বলেও তারা জানান। তাদের এই সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে প্ল্যানচেট বা সিয়াঁস-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার উপরে। মজার ব্যাপার, বিভিন্ন সময় ও কালের বিভিন্ন প্যারানর্মালবিদ একই বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন, দিয়ে চলেছেন।
কিন্তু এতেও বোঝা সম্ভব নয়, ঠিক কতদিন বিদেহী আত্মা প্রেতাবস্থায় বিচরণ করে। হিন্দু ধর্মে গয়া, ত্র্রিবেণীসঙ্গম, হৃষিকেশ প্রভৃতি স্থানে পিণ্ডদানের বিধান রয়েছে। বিধান রয়েছে নিকটজনের মৃত্যুর বাৎসরিক শ্রাদ্ধেরও। তা হলে কি এক বছর সময় লাগে মায়ার বাঁধন কাটতে? না, তেমন কোনও নির্ধারিত সময়ের কথাও তো কেউ বলেননি!
প্যারনর্মালবাদীদের একাংশ জানান, মৃতেরা জীবিতদের কোনও দিনই ছেড়ে যান না। তারা ‘সাথে সাথে’-ই ঘোরেন। তবে তাদের অবস্থান ঘটে অন্য টাইম অ্যান্ড স্পেস-এ। এই যুক্তিকেই ব্যবহার করেছেন জে কে রাওলিং তার ‘হ্যারি পটার’ সিরিজে। হ্যারির প্রয়াত মা-বাবা, তার গডফাদার সিরিয়াস ব্ল্যাক- সকলেই হ্যারির সঙ্গেই থাকে। কেবল একটা আবছা পর্দা বিরাজ করে তাদের মাঝখানে।
এই কারণেই কি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দেন বেশ কিছু নামকরা মানুষের প্রেতাত্মা? নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স বিষয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন মার্কিন দেশের রেমন্ড মুডি। তার কথায় ১৯৭৭ সালে প্রয়াত সঙ্গীত তারকা এলভিস প্রিসলির প্রেতাত্মাকে নাকি আজও দেখা যায় মেমফিস অঞ্চলে। ফরাসি বিপ্লবে নিহত রাণি মারি আঁতানোয়েৎকেও নাকি অনেকেই দেখেছেন প্যরিসের কোনও কোনও জায়গায়। এরা কি অনুভব করেননি এদের মৃত্যুকে? না। উত্তর দেওয়ার জন্যে এরা কেউ ফিরে আসেননি।
৫০০০ বছর আগে প্রয়াত মিশরীয় লেখক আমেনহোটেপের আত্মার কথাও এই প্রসঙ্গে উঠে আসে। তিনিই বিখ্যাত ‘বুক অফ ডেড’-এর রচয়িতা। তার প্রেতকে প্রত্যক্ষ করেছেন, এমন দাবি করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। অথচ প্রাচীন মিশরীয়রাই বিশ্বাস করতেন, ৪০ দিন বিদেহী আত্মা তার নিকটজনের কাছে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু স্বয়ং ‘বুক অফ ডেড’-এর রচয়িতার প্রেতাত্মাই যদি দৃষ্ট হয় বার বার, তা হলে সেই বিশ্বাসে আস্থা রাখা যায় কি?
হিন্দুরা মৃতের দেহাবশেষ নদীতে বিসর্জন দেন। খ্রিস্টানরাও দাহকার্য হলে চিতাভস্ম ছড়িয়ে দেন। ১৯৬৩ সাল থেকে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের দাহকার্য চার্চ অনুমোদন করে। তার পর থেকে এমন কাজ অনেকেই করেন। দেহাস্থি বিসর্জনের অর্থ, দেহ সংক্রান্ত সংস্কার থেকে মৃতের আত্মাকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু তার পরেও প্রেতযোনি হানা দেয়।
কেন ফিরে আসে প্রেত? মায়া ছাড়াও আর একটি বিষয়ের কথা বলেন অতিপ্রাকৃতবাদীরা। অনেক সময়েই নিজের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে প্রেতযোনিপ্রাপ্তরা ফিরে আসে- এমন মতকেও ফেলে দেওয়া যায় না।
মায়া ছাড়াও, ঈর্ষা, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদিও প্রেতকে আটকে রাখে জীবিতের জগতে। ‘মুক্তি’-র বিষয়টা নির্ভর করে তার হাতেই। এমন কথা অনেকেই মনে করেন। কিন্তু যদি পরলোক ইহলোকের সঙ্গে সঙ্গে থাকা এক সমান্তরাল জগৎ হয়ে থাকে, যদি প্রয়াতরা জীবিতের পাশাপাশিই থেকে যান, তা হলে ক্ষতি কোথায়? বরং এমন কনসেপ্ট তো জীবিতকেই আশ্বাস জোগায় তার চরম নিঃসঙ্গতার মুহূর্তে, তার সংকটের কালে। এ থেকেই জীবিত আর মৃতদের নিয়ে গড়া যায় এক সামগ্রিক জগতের কল্পনা। যা হয়তো অনেক অবসাদ থেকে রক্ষা করে জীবিতদের। হয়তো প্রয়াতদেরও। সে খবর আমরা পাব না। সূত্র: এবেলা।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু