আজ: বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১, বুধবার |

kidarkar

মায়েরা কি টিকা নিতে পারবেন?

শেয়ারবাজার ডেস্ক: গর্ভবতী মা ও স্তন্যদানকারী মায়েদের টিকা না দেওয়ার প্রসঙ্গটির প্রতিও সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। টিকা আবিষ্কারক কোম্পানিগুলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সব দেশের ওষুধ ও টিকা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসমূহ মায়েদের এই পর্যায়ে টিকা না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু দেশে-বিদেশে এবিষয়ক গবেষণার যতটুকু খবর আসে, তাকে ভিত্তি করে বলতে চাই যে, গর্ভবতী হলেই সেই মাকে কখনো কোনো টিকা দেওয়া যাবে না তা কিন্তু নয়। গর্ভবতী মা, নবজাতক ও ছোট বাচ্চাদের প্রচলিত বিভিন্ন টিকা দেওয়া হচ্ছে তাদের সুরক্ষার জন্যই এবং মূলত বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে তাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরিকে কার্যকরভাবে উত্সাহিত করার লক্ষ্যে। এসব টিকা যখন আবিষ্কৃত হয়, তখনো এগুলো গর্ভবতী মা, স্তন্যদানকারী মা ও ১৮ বছরের কম বয়সিদের দেওয়া হতো না। পরবর্তী সময়ে আরো ব্যাপক গবেষণায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের এবং নিরাপদ মাত্রা নির্ধারিত হওয়ার পর ১৮ বছরের নিচের অপ্রাপ্তবয়স্কদের এগুলো দেওয়া শুরু হয়।

করোনার টিকাও এন্টিবডি তৈরি করে। বিভিন্ন করোনা টিকার ক্লিনিক্যাল স্টাডিগুলো চলার সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর যে ৪৫ হাজার, ৩০ হাজার, ৪৭ হাজার ও ৪৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর এগুলোর পরীক্ষা হয়, সেখানে কিন্তু গর্ভবতী মায়েরা সংখ্যায় কম হলেও ছিলেন। তাদের বিষয়ে কোম্পানিগুলোর রিপোর্টে কিছু উল্লেখ না থাকলেও তাদের রিপোর্টে মায়েদের কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়নি। কোম্পানি বলেছে, তারা আরো গবেষণা করে এদের সম্পর্কে জানাবে। কেউ কেউ সেই পরীক্ষা শুরুও করেছে। কিন্তু এতে সময় লাগবে। ততদিন আমাদের গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েরা অরক্ষিত থাকছেন। ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বেলায় মাত্রা নির্ধারণের বিষয় আছে। কিন্তু এ দুই ধরনের মায়েদের বেলায় কোনো টেরাটোজেনিক ইফেক্ট, অর্থাত্ গর্ভস্থ ভ্রূণের কিংবা মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশুর কোনো ক্ষতি না হলে বিষয়টা তত জটিল নয়। এই ক্ষতির আশঙ্কা বিষয়ে বেশ কিছু বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানীরা কিছু গবেষণা করেছেন এবং এখনো করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেটরিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস (এসিওজি), আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস, একাডেমি অব ব্রেস্টফিডিং মেডিসিন, সোসাইটি ফর মেটারনাল ফিটাল মেডিসিন, এমনকি মার্কিন নীতিনির্ধারণী সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পর্যন্ত এ সম্পর্কে সাবধানতাসূচক কিন্তু কোনো নেতিবাচক কথা বলেননি।

একাডেমি অব ব্রেস্টফিডিং মেডিসিন ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত তাদের এবিএম স্টেটমেন্টে বলেছে যে, যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো ক্লিনিক্যাল ডাটা নেই, তবু যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গর্ভবতী কিংবা বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের করোনার টিকা দেওয়া নিষিদ্ধ করেনি। সম্মুখ সারির করোনা যোদ্ধাদের মধ্যেও অনেক বুকের দুধ খাওয়ানো মা রয়েছেন এবং একাডেমি অব ব্রেস্টফিডিং মেডিসিন করোনার টিকা নেওয়ার কারণে তাদের বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে বলেনি। সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে। তবে টিকা নিয়ে বুকের দুধ খাওয়ালে ক্ষতি হবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম, বরং মায়ের শরীরে সৃষ্ট এন্টিবডি ও টি-সেল দুধের মাধ্যমে বাচ্চার শরীরে গিয়ে কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে। এই একাডেমি যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি অ্যাডভাইজরি কমিটি অন ইমিইনাইজেশন প্র্যাকটিসকে উদ্ধৃত করে বলেছে, গুটিবসন্ত ও পীতজ্বরের টিকা ছাড়া অন্য টিকাগুলো স্তন্যদানকারী মা ও তার শিশুর ক্ষতি করে না।

মায়েরা কি টিকা নিতে পারবেন?

আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেটরিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস (এসিওজি) তাদের গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এবং অতি সম্প্রতি (২৭ জানুয়ারি ২০২১) হালনাগাদকৃত রিপোর্টে বলেছে, গর্ভবতী কিংবা বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের করোনার টিকা দেওয়া থেকে বিরত রাখা ঠিক হবে না। এই টিকা নেওয়ার আগে নারীদের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তবে কোনো গর্ভবতী মা যদি এই টিকা নিতে না চান, তাহলে তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হবে।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস তাদের প্রশ্নোত্তর পেজে এ বিষয়ে বলছে, যদিও যথেষ্ট ডাটা নেই এবং গবেষণা চলছে, তবে গর্ভধারণ বা বুকের দুধ খাওয়ালে করোনার টিকা নেওয়া যাবে না এমন নয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যতটুকু গবেষণার ফল পাওয়া গেছে, তাতে বুকের দুধ খাওয়ালে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। এরাও অন্য সংস্থাগুলোর মতোই বলছে যে গর্ভবতী, গর্ভধারণের সম্ভাবনাময় কিংবা স্তন্যদানকারী মা যারা করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ সারিতে রয়েছেন, তারা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়া করোনার টিকা ইচ্ছা করলে নিতে পারেন।

মার্কিন নীতিনির্ধারণী সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এ বিষয়ে ৭ জানুয়ারি ২০২১ প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে, সম্মুখ সারির করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে যারা সন্তানসম্ভবা, তাদের করোনার টিকা নেওয়াই ভালো। কারণ অন্যদের তুলনায় তাদের মারাত্মক পর্যায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিছুটা বেশি। এর মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি, ভেন্টিলেশনে থাকা এবং মৃত্যুঝুঁকি, এছাড়া সময়ের আগেই জন্মদানের মতো গর্ভসংক্রান্ত ঝুঁকিও যারা সন্তানসম্ভবা নন তাদের চেয়ে বেশি। তবে এরকম মায়েরা করোনার টিকা নেবেন কি না, তা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়।

গর্ভবতী মায়েরা টিকা নিলে সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সিডিসি বলেছে যে এটা তাদের জন্য ভিন্ন কিছু হবে না, বরং অন্যদের মতোই দ্বিতীয় ডোজের পর হালকা জ্বর, কিছুটা ব্যথা বা ফোলার সম্ভাবনা আছে, যা এসিটামিনোফেন (অর্থাত্ প্যারাসিটামল) খেলেই চলে যায়। যদি কারো আগে থেকেই এলার্জির ইতিহাস থাকে, তাহলে টিকা নেওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। টিকা নেওয়ার আগে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার প্রয়োজন নেই। যারা গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছেন, তাদেরও টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই।

গবেষণা চলছে। তবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সিডিসি বলছে যে, বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েরা করোনার টিকা নেওয়ার পরেও বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে কোনো ঝুঁকি থাকার কথা নয়। এদের মধ্যে যারা সম্মুখ সারির যোদ্ধা, তারা চাইলে টিকা নিতে পারেন।

আমাদের আজকের এই আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর মতামত তুলে ধরা হয়েছে। কারণ তারা নতুন প্রযুক্তি এমআরএনএ-ভিত্তিক দুটি টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবহূত অক্সফোর্ডের টিকাটি তা নয়, বরং তাত্ত্বিকভাবে আরো সহজ ও বিশ্বময় এতকাল ধরে প্রচলিত এডিনো ভেক্টরভিত্তিক টিকা হওয়ার কারণে এবিষয়ক ঝুঁকি আরো কম থাকার কথা। তবু জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার ইচ্ছা রইল।

কারণ বর্তমানের জরুরি জনস্বাস্থ্যগত পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে করোনার নতুন নতুন ভেরিয়্যান্টদের মোকাবিলা করতে হলে করোনা টিকার আওতার বাইরে রাখা আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের ও তাদের বাচ্চাদের নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।

লেখক : পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্স সেন্টার ও সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ারবাজার নিউজ/মি

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.