আজ: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৮ অগাস্ট ২০২১, বুধবার |

kidarkar

আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান আর নেই

শেয়ারবাজার ডেস্ক: আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান, লালবাগ এলাকার সাবেক এমপি ও সিটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন ডিমেনসিয়া রোগে ভুগে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে তার।

মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) সকাল ১০টায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় মরহুমের জানাজার নামাজ ধানমন্ডির ৭নং রোডে অবস্থিত বাইতুল আমান মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে।

আলহাজ আনোয়ার হোসেন ১৯৩৮ সালে ঢাকার লালবাগে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে পরিবার-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি।

আজকের আনোয়ার গ্রুপ নামের যে বড় শিল্পগোষ্ঠী, মালা শাড়ির উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন তারই প্রতিষ্ঠাতা। দেশের কয়েকটি পুরোনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠী তারই হাতে তৈরি। মালা শাড়ি বাংলাদেশের শাড়ির জগতে প্রথম সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ড। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি।

আনোয়ার হোসেনদের পারিবারিক ব্যবসা অনেক পুরোনো। ১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন আনোয়ার সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করে মালা শাড়ি বাজারে আনেন। গত শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’। তিনি নিজে পরিচিতি পেয়েছিলেন মালা শাড়ি দিয়ে। সবাই তাঁকে বলতেন মালা শাড়ির আনোয়ার। বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপ বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বিমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির অধীনে রয়েছে ২০টি কোম্পানি।

আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালে হলেও তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা শুরু তারও ১০৪ বছর আগে ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (লাট মিয়া)। ফলে এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৩ বছর।

আনোয়ার হোসেনের বাবার নাম রহিম বখ্স। ১৯৪৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে রহিম বখ্স ছিলেন ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে চারজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একজন। আনোয়ার হোসেনের নিজের ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে। এর আগে কয়েক বছর তিনি পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন।

১৯৪৫ সালে আনোয়ার হোসেনের বাবার মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স সাত বছর। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা বিপাকে পড়ে যায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পড়ে আনোয়ার হোসেনের ওপর। আনোয়ার হোসেনের প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আনোয়ার ক্লথ স্টোর। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। একসময় ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়। ১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে নিয়ে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ির ইতিহাস। তখন ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দোকান, কার্যালয়, বাড়ি-গাড়ি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে আনোয়ার হোসেনের বয়স ছিল ৩৩ বছর। তিনি সে সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

আনোয়ার হোসেনের স্ত্রীর নাম বিবি আমেনা। আনোয়ার-আমেনা দম্পতির সাত সন্তান। চার মেয়ে ও তিন ছেলে। প্রথম তিন সন্তান মেয়ে—শাহীন বেগম, সেলিনা বেগম মালা ও হাসিনা বেগম রুমা। আরেক মেয়ের নাম শাহনাজ বেগম মুন্নী। আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত মালা শাড়ির নাম দেওয়া হয় দ্বিতীয় সন্তান সেলিনা বেগম মালার নাম অনুসারে। চতুর্থ সন্তান মনোয়ার হোসেন, যিনি এখন আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আনোয়ার সিমেন্ট, আনোয়ার স্টিল মিলস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মানোয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানশাইন কেব্লসের ব্যবসা সামলান তিনি। মেজ ছেলের নাম হোসেন মেহমুদ। টেক্সটাইলে বিশেষ আগ্রহ থাকায় তিনি এখন হোসেন ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেহমুদ ইন্ডাস্ট্রিজ, আনোয়ার সিল্ক, আনোয়ার টেক্সটাইল ও আনোয়ার টেরিটাওয়েলের ব্যবসা দেখাশোনা করেন তিনি।

ছোট ছেলে হোসেন খালেদ। তিনি দেখাশোনা করেন আনোয়ার জুট মিলস, এজি অটোমোবাইলস, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিসহ কয়েকটি ব্যবসা। হোসেন খালেদ সবচেয়ে কম বয়সে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হন। হোসেন খালেদের স্ত্রী আনিকা ফারহীন বিয়েতে মালা শাড়ি পরেছিলেন। বিয়ের আগে ভাইয়ের হবু স্ত্রীকে মালা শাড়ি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেনের মেয়েরা। আকদের দিন হোসেন খালেদের স্ত্রী সেটিই পরে আসেন।

পুরান ঢাকার আমলীগোলার বাড়িতেই নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক সকাল-সন্ধ্যা চিত্রায়িত হয়েছিল। আনোয়ার হোসেনের ছোট মেয়ে মুন্নী আর তার (আনোয়ার হোসেনের) বড় ভাইয়ের ছেলে মঞ্জু অভিনয় করেছিলেন ওই নাটকে।

১৯৭৮ সালে ৪০ জন ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বললেন দেশে বেসরকারি ব্যাংক দরকার। রাজি হলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো দি সিটি ব্যাংক, চারবার সেটির চেয়ারম্যান ছিলেন আনোয়ার হোসেন। এরপর রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিন বছর সাংসদ (ঢাকা-৮ আসনের) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল আনোয়ার হোসেনের। হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংগঠনে সহায়তায় উদারহস্ত আনোয়ার হোসেন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি সামাজিক কল্যাণে ভূমিকা রাখছে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.