আজ: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২, রবিবার |

kidarkar

ব্যাংক খাতে ৫৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন

এ জেড ভূঁইয়া আনাস: দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তফসিলি ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপনের ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই। খেলাপি ও অবলোপন ঠেকাতে নানান ধরণের সুযোগ সুবিধা দেয়ার পরেও কমানো যাচ্ছে না মন্দ ঋণের পরিমাণ। গেল ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করেছে ৯৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে পূর্ববর্তী বছরের পরিমাণসহ ৪৭২ কোটি টাকা যা মোট অবলোপনের অর্ধেকেরও কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ থেকে অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেঁড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান খেলাপির পরিমাণ রয়েছে তার ৫৭ দশমিক ৩১ শতাংশ ঋণ অবলোপন হয়েছে। এ দুটি সংখ্যা যোগ করলে ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা।

ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়মানুযায়ী ব্যাংকগুলোর অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপি নানা শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। কাগজে কলমে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংক। দীর্ঘদিন অনাদায়ী গ্রাহকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যালেন্স শিট থেকে মুক্ত করতে ঋণ অবলোপনের পথে ঝুঁকছে সবগুলো ব্যাংক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিটকে খেলাপির ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে অবলোপনের পথ বেছে নেয়। এর ফলে ৩ বছরের বেশি ঋণ যা মন্দ মানে রয়েছে সে ঋণগুলোকে অবলোপন করে। সেক্ষেত্রে তাদের আয়ের টাকা দিয়ে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। তবে কিছু ব্যাংক মর্টগেজ বা বন্ধকি সম্পত্তিকে পুনরায় অ্যাসেসমেন্ট করে কিছু সুযোগের আশ্রয় নেয়।’

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ অবলোপনের সুযোগ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সুযোগ তখন থেকেই ব্যাংকগুলো ব্যবহার করে আসছে। যদিও, শুরুতে নিয়ম ছিল ৫ বছরের বেশি যে মন্দ ঋণগুলো আদায় করা যাচ্ছে না সেগুলো ঋণ অবলোপন করা যেত। কিন্তু এখন তা ৩ বছর হলেই অবলোপন করা যায়। সাধারণত, খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম সে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে এ ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা যায় না।

এদিকে, অতি সম্প্রতি খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে মামলা ছাড়া সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। আর এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই মন্দ ঋণ অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নীতিমালা শিথিল করার কারণে খেলাপি ঋণগুলোকে অবলোপনের হার বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।

গেল এক দশকে ঋণ বিতরণের নানা অনিয়মের ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অত্যাধিক হারে বেড়ে যায়। এ কারণে ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ১০ কোটি টাকার অধিক কিন্তু ৫০০ কোটি টাকার কম এমন ঋণে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। কিন্তু ২০২০ সালে কোভিডের আঘাতের ফলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় কয়েক দফায় সুযোগ বাড়ায় সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে কোভিডের প্রথম বছর ২০২০ সালে কেউ ঋণের এক টাকা পরিশোধ না করলেও কাউকে খেলাপি দেখাতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এরপর গেল বছর ২০২১ সালে এই সুযোগ কিছুটা কমিয়ে কিস্তির ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই খেলাপি না দেখাতে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুযোগ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। নতুন করে আর কোন সুযোগ বাড়ানো হয়নি। যদিও, ব্যবসায়ী নেতা এবং সংগঠনগুলো নতুন করে এ সুবিধা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করছে। তবে, এ সুবিধা নতুন করে না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনঢ় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতসব সুযোগ সুবিধা দেয়ার পরও ঋণ খেলাপির হার কমাতে পারেনি ব্যাংকগুলো। গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের অনীহার কারণেই খেলাপি বেড়েছে বলে অভিমত ব্যাংক কর্তাদের। তাই ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও আর কোন সুযোগ না দেয়ার আবেদন রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘খেলাপি যারা তাদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। সুযোগ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা লোন পরিশোধ করে না। বিভিন্ন সুযোগ দেয়ায় এ বছর ঋণ অবলোপনের হার কম। নয়তো এ সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কয়েক গুণ হতো।’
এদিকে, ২০১৫ সালে বড় ঋণগ্রহীতাদের দেয়া ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের জন্য ফের সুযোগ চাওয়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়।

সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকি খাতে মোট ঋণ অবলোপন হয়েছে ৫৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। তবে ২০০৩ সাল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আদায় শেষে এখন ব্যাংকগুলোর অবলোপন করা ঋণের মূল পরিমাণ দাঁড়াল ৪৩ হাজার ৬০৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ রয়েছে ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিমাণ হলো ২৪ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবলোপনের পরিমাণ ৩৬৫ কোটি টাকা।

এদিকে, ২০১৯ সালে নতুন ভাবে ঋণ অবলোপন করা হয় ২ হাজার ৫৯৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একই বছরে পূর্বের অর্থাৎ ২০১৮ সালের ও ২০১৯ সালের সব মিলিয়ে মোট আদায় করা হয় ৮৩১ কোটি টাকা। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয় ৯৭০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। একই সময়ে আদায় করা হয় ৭৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এছাড়া বিদায়ী ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে ৯৭৩ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়। এর বিপরীতে একই সময়ে সুদসহ আদায় হয়েছে মাত্র ৪৭২ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থঋণ আদালতে উল্লেখযোগ্য পরিমান মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকায় মামলা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এছাড়াও চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবী রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশে যে মামলাগুলো স্থগিত রয়েছে, সেগুলো স্থগিতাদেশ বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। স্থগিত মামলাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আইনমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি কাছে দিতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে এসব স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।’

এছাড়াও অর্থঋণের আদালত ও বিচারক বৃদ্ধি এবং দক্ষ বিচারক দিয়ে এসব মামলার বিচার পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ অবলোপনের নীতিমালা করা হয়েছিল ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণকে সহজে আদায়ের জন্য। তবে অর্থঋণ আদালতের নানা দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে এভাবে আদায় খুবই স্লথ গতিতে হচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরোণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
এছাড়া, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, রাষ্ট্রের সবগুলো সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও জানান সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.