৮ ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ২০,৮৬৩ কোটি টাকা
এ জেড ভূঁইয়া আনাস: করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিকের পরেও ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিছু ব্যাংক আমানতের সুরক্ষা হিসাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) লক্ষ্য পূরণে ব্যার্থ হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রয়াত্ব জনতা ব্যাংকসহ মোটি ৮টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত সঞ্চিতি রক্ষা করতে পারে নি। এতে এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। আমানতকারীরা দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ পর্যন্ত প্রান্তিকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রেখে দেওয়ায় ঘাটতির হিসাবে কম লক্ষ্য করা গেছে। আর উদ্বৃত্ত সঞ্চিতি রক্ষার ফলে মোট সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ কমে ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা হয়েছে। যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় মূলত আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু যেসব ব্যাংক সঞ্চিতির কোটা পূরণ করেতে পারে নি সেসব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ ব্যাংক কোন কারণে খেলাপি হলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া কঠিন হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তারা সঞ্চিতি ঘাটতির সমান টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলে জমা দেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে ঘাটতির টাকা জমা না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে চাপের মধ্যে রাখবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোন ব্যাংক দেওলিয়া হলে সেই ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে লিখিত কোন আইন পর্যন্ত নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতাও বলা যায়। আর আইন না তাকায় দেওলিয়া কোন ব্যাংকের আমানকারীদের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য আমানত রক্ষায় আমানতকারীদের সজাগ থাকতে হবে। তবে তারা ব্যাংক সম্পর্কে তথ্য জানবেন কোথা থেকে। কারণ অনেক ব্যাংকের তথ্য আর বাস্তাবতার মিল থাকে না। এটা নিয়ে নতুন আইন করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির শীর্ষে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের পরিমান ৮ হাজার ১৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতিতেোবস্থান করা বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ১০৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতির পরিমান ৩ হাজার ২২৫ কোটি ৪১ লাখ ও রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। একইভাবে, বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১১ কোটি ১০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৩১ কোটি ২৩ লাখ, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৩১ লাখ ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রভিশন সংরক্ষণ করাই হয় আমানতকারীদের স্বার্থে। কোনও ব্যাংক যদি তা রাখতে না পারে, তাহলে দুশ্চিন্তায় পড়ে আমানতকারীরা। এ কারণে ব্যাংকগুলোর উচিত আমানতের নিরাপত্তি সঞ্চিতির ঘাটতি দ্রুত পূরণ করা।’
২০২২ সালের মার্চ শেষে দেশে বিতরণ করা মোট ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ব্যাংকের সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমান ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ৪টি ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমান ৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে সঞ্চিতি রাখতে হয়। নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনও প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমানতের বিপরীতে নিরাপত্তআ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। এটা করতে না পারলে আমানতকারীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।