৩৭% এইডস রোগী শনাক্তের বাইরে, চিকিৎসা নিচ্ছে না অনেকেই
শাহ আলম নূর : বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত অনুমানিক ১৪ হাজার রোগীর মধ্যে ৩৭ শতাংশ এখনো শনাক্তের বাইরে। আর শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে চিকিৎসার বাইরে রয়েছে ২৩ শতাংশ রোগী। শনাক্ত ও চিকিৎসার বাইরে থাকা রোগীদের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংক্রমিত অনেকেই দেশ ছেড়েছেন; আর যারা দেশে আছেন তাদের অনেকেই টেস্টের সময় যে ফোন নম্বর/ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতে রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। উদ্যোগের অধীনে, রোগী শনাক্ত বাড়াতে ও চিকিৎসার আওতায় আনতে ১০টি কারাগারে এইচআইভি পরীক্ষা সুবিধা চালু করা, এইডস রোগীদের দিয়ে মাঠকর্মীর কাজ করানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ।
জয়েন্ট ইউনাইটেড নেশনস প্রোগ্রাম অন এইচআইভি/এইডস (ইউএনএইডস)- এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস রোগের প্রাদুর্ভাব ০.০১ শতাংশের কম। সেই হিসেবে দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর আনুমানিক সংখ্যা ১৪ হাজার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৬১ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে; এই রোগীদের মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার ৫৮৮ জন। সংক্রামিত ব্যক্তিদের তুলনায় শনাক্তকরণের হার ৬৩ শতাংশ।
যদিও ন্যাশনাল এইচআইভি-এইডস প্রোগ্রামের মাধ্যমে শনাক্ত সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি; ৭৭ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২৩ শতাংশ সংক্রামিত লোক চিকিৎসার বাইরেই রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমিত লোকদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
এইডস প্রোগ্রামের কর্মকর্তারা জানান, তারা রোগীদের সন্ধান বের করার চেষ্টা করছেন।বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং দেশের প্রথম জাতীয় এইডস কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এইচআইভি টেস্ট করে শনাক্তের হার বাড়ানো এবং যারা শনাক্ত হবে, তারা যাতে চিকিৎসার আওতায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।”
সংক্রামক এই ব্যাধি মোকাবেলায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৯৫-৯৫-৯৫ লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে ইউএনএইডস। এর আওতায় এইচআইভিতে আক্রান্ত লোকেদের ৯৫ শতাংশ তাদের এইচআইভি স্ট্যাটাস জানবে, যারা এইচআইভি পজিটিভ তাদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার জন্য তালিকাভুক্ত হবে, এবং চিকিৎসাধীন আক্রান্তদের ৯৫ শতাংশের ভাইরাল লোড, অর্থাৎ তাদের দ্বারা যেন অন্যরা আক্রান্ত না হয় তা দমন করা হবে।
২০২৫ সালের মধ্যে এইডস নিয়ন্ত্রণে ইউএনএইডসের ৯৫-৯৫-৯৫ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্জন ৬৩-৭৭-৯৩।
আজ বিশ্ব এইডস দিবসে এক কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সর্বশেষ এইডস পরিস্থিতি ঘোষণা করা হবে। ‘ইক্যুয়ালাইজ’ বা ‘সমান’- এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্যের অর্থ হল, এইডস নির্মূলের লড়াইয়ে বাধা সৃষ্টিকারী সবকিছুকে দূর করতে প্রত্যেকেরই এগিয়ে এসে কাজ করতে হবে।
ওষুধে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে এইডস রোগীরা
অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “এইডস রোগীরা নিয়মিত ওষুধ খেয়ে দীর্ঘদিন সুস্থ্য থাকতে পারে।”
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এইডস রোগ শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। শনাক্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি ছিলেন একজন বিদেশি নাগরিক। এরপর ১৯৯০ সালে দুজন বাংলাদেশি নাগরিক এইচিআইভি পজিটিভ হন।
তাদের মধ্যে একজন এখনো সুস্থ্য আছেন; অন্যদিকে, এইডস আক্রান্ত হওয়ার পর আরেকজন এইডস রোগীকে বিয়ে করেছেন। দুটি সুস্থ্য সন্তান রয়েছে ওই দম্পতির।
“এইডস শনাক্ত হলে, তা লুকোনোর বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ থাকতে পারবেন, সেইসঙ্গে পরিবার ও সমাজের সাধারণ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমবে,” বলেন ড. নজরুল।
কারাগারে এইচআইভি টেস্ট করা হচ্ছে
দেশের ২৩টি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত জেলা- যে জেলাগুলোয় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বেশি, অর্থাৎ প্রতি বছর বেশি সংখ্যক রোগী পাওয়া যায়, সেসব জেলায় ‘কম্প্রিহেনসিভ ট্রিটমেন্ট’ দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি চলতি বছর ১০টি কারাগারে এইচআইভি টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যনেজার (ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়) মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন,, “২০২৫ সালের মধ্যে ইউএনএইডস লক্ষ্য অর্জনে আমরা কাজ করছি। এইডস রোগীদের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করতে এ বছর আমরা ১২টি এইচআইভি-এইডস ট্রিটমেন্ট সেন্টারে একজন করে এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিকে মাঠকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি।”
“একজন এইডস রোগী যখন অন্যকে বলছে, আমি একজন এইচআইভি পজিটিভ রোগী আমি চিকিৎসা নিয়ে ভালো আছি, আপনারাও চিকিৎসা নিন; তখন তারা আগ্রহী হচ্ছে চিকিৎসা নিতে।”
”কারাবন্দিদের একটি বড় অংশ মাদকসেবী ও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই তাদের ঝুঁকি বেশি। সে কারণে কারাগারে এইচআইভি টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত চার মাসে টেস্ট করে কারাগারে এইডস রোগীও পাওয়া গেছে,” যোগ করেন তিনি।
মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, “রোহিঙ্গারা আমাদের মধ্যে ঝুঁকির অন্যতম কারণ। তাদের মধ্যে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব ০.৮ শতাংশ; অন্যদিকে, বাংলাদেশিদের মধ্যে ০.০১ শতাংশের কম।”
তবে রোহিঙ্গার পাশাপাশি আরও একটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন মোঃ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, “সংক্রমণ এখন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে আসছে। আমরা জানি, দৌলদিয়ায় যৌনপল্লীতে কয়েক হাজার মানুষ আছে, চাংখারপুলে শিরায় মাদকসেবী বেশ কয়েকজন আছে, যারা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো ১৭ কোটি। তাদের মধ্য থেকে এইডস রোগী খুঁজে বের করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৬১ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে; এর মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার ৫৮৮ জন।
২০২১ সালে দেশে অন্তত ৭২৯ জন নতুন এইডস রোগী শনাক্ত হয়; এরমধ্যে মারা যায় ১৮৮ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ সাধারণ মানুষ, ২০ শতাংশ অভিবাসী, ৮ শতাংশ শিরায় মাদক সেবনকারী, ২৬ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, ৯ শতাংশ সমকামী জনসংখ্যার সদস্য, ৭ শতাংশ পুরুষ যৌনকর্মী, ২ শতাংশ হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্য এবং ২ শতাংশ নারী যৌনকর্মী।