আজ: বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ইং, ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১১ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার |

kidarkar

উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে দরকার অনেক বেশি বিনিয়োগ

নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে অবকাঠামো নির্মাণ- রূপালী চৌধুরী

রূপালী চৌধুরী বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। একজন কর্মী থেকে নিজ দক্ষতা আর যোগ্যতায় এখন তিনি একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ নেতৃত্বে। কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা তিনিই প্রথম বাংলাদেশি নারী। তার প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের রংশিল্পে এক নম্বর ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের রঙের বাজারের অর্ধেকের বেশি তারা নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসার পাশাপাশি বার্জারের রয়েছে নানা সামাজিক-মানবিক উদ্যোগ। যার নেতৃত্বে এই এগিয়ে চলা, নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয়, তিনি রূপালী চৌধুরী। দেশের অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন শেয়ারবাজার নিউজ ডটকমের সাথে। রূপালী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেয়ারবাজার নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার শাহ আলম নূর।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে এখন এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কেমন হচ্ছে।

রূপালী চৌধুরী:আগের যে কোন সময়ের তুলনায় দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ(এফডিআই) বাড়ছে,তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিদেশি বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতিতে নানা ভাবে অবদান রাখছে। এখানে বিদেশী বিনিয়োগে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স পাচ্ছে। একই সাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর কর্মসংস্থান করছে।

UNCTAD এর প্রকাশিত World Investment Report 2022 অনুসারে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে ২.৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তিন দশমিক ৬১৩ বিলিয়ন বা ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এফডিআই এসেছিল। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকার সারা দেশে ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছেন। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি সবাই বিনিয়োগ করতে পারেন। এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। আমরা অনেক দিন ধরে এমন একটি উদ্যোগের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে আসছিলাম।

তবে একটি বিষয় খেয়াল করা দরকার। আমরা লক্ষ্য করছি যে বেজা গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও সার্ভিস চার্জ বাবদ বেশ উঁচু হারে চার্জ করবে,ফলে একজন বিদেশি বিনিয়োগকারি হয়তো এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ পাবে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এমন অথনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকিতে ইউটিলিটি সেবা দেয়া হয়। তাই দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো আমাদের প্রতিযোগি দেশগুলোর সাথে তুলনা করে পরিচালনা করতে পারলে অনেক বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আমি মনে করি।

ব্যবসা সহজীকরনের ব্যাপারে বিভিন্ন ফোরামে অনেক কথা আলোচনা হচ্ছে। ব্যবসা সহজীকরনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়ার জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় দেশে এখন ব্যবসা পরিচালনা করা অনেক সহজ হয়েছে। তবে কিছু কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে যা দ্রুত সমাধান করা দরকার।

প্রশ্ন: এফডিআই’র সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলুন।

রূপালী চৌধুরী: আমি আমাদের দেশ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। আমাদের এখানে যারা কাজ করতে আসে তারা সহজে যে কোন কাজ শিখে নিতে পারে। এসব মানুষগুলো অনেক বেশি আন্তরিক। অনেকে বলে আমাদের দেশে জনশক্তি অনেক সস্তা। বরং আমার মনে হয় আমাদের দেশের জনশক্তি অনেক কর্মক্ষম ও দক্ষ। আমাদের দেশের মানুষগুলোকে যদি ঠিক ভাবে প্রশিক্ষন দেয়া যায় তবে তারা খুব সহজে কাজ শিখে নিতে পারে। যে দেশে এত বিপুল পরিমান জনশক্তি আছে সেখানে অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে। এছাড়া আমাদের দেশের মানুষগুলো অল্পতেই অনেক বেশি সন্তুষ্ট হয়।

আমাদের দেশের উন্নয়নে অনেক বেশি বিনিয়োগ দরকার। সরকার দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সম্প্রতি অনেক বড় বড় প্রকল্প নিয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায় এসব প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে একদিকে খরচ বাড়ছে, অন্য দিকে ব্যবসা পরিচালনা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল তথ্য যাচ্ছে। এজন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে।

প্রশ্ন: করোনার প্রভাব থেকে আপনারা কতটুকু বের হয়ে আসতে পেরেছেন।

রূপালী চৌধুরী : করোনার কারনে সকলের মত আমাদের কোম্পানিতে ও বেশ প্রভাব পড়েছিল। তবে আমাদের লক্ষ্য ছিল করোনার কারনে কোন জনশক্তিকে চাকুরীচ্যুত করা যাবে না। করোনার কারনে ব্যবসা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও ২০১৯-২০২০ সালে আমরা ৩% প্রবৃদ্ধি করেছিলাম। করোনার সময় আমি ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এর প্রেসিডেন্ট ছিলাম। তখন আমি ইয়াংওয়ান সহ অন্য সদস্যদের সাথে কাজ করে বিভিন্ন সরকারি হাসপালে ১১,০০০ পিপিই বিতরন করেছি। তবে করোনার প্রভাব চলে গেলেও আমরা বর্তমানে একটি কঠিন সময় পার করছি। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এজন্য আমাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে।তবে যে পরিমান ব্যয় বেড়েছে আমরা দাম ততটা বাড়াইনি।

প্রশ্ন: দেশের শেয়ার বাজার সম্পর্কে কি বলবেন?

রূপালী চৌধুরী : বর্তমান কমিশনের নেতৃত্বে দেশের শেয়ার বাজার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন বৃদ্ধির জন্য বিএসইসি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক রোড শো করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাজারের উপর ভাল প্রভাব ফেলবে বলে আমি আশা রাখি।

শেয়ার বাজারে আসার মাধ্যমে যে কোন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে আসা উচিত। শেয়ার বাজারে আসলে অনেক তথ্য প্রকাশ করতে হয়। আমার মনে হয়, অনেকেই এসব তথ্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত নয়। আবার শেয়ারবাজারে আসলে কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের ও একটি চাপ থাকে। তাই এ কারণে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসতে চায় না।

প্রশ্ন: আমাদের পিছিয়ে পড়া নারীদের সামনে এগিয়ে আনার জন্য একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসেবে আপনার পরামর্শ?

রূপালী চৌধুরী: আমি নিজেও একজন নারী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। আমি ১৯৯০ সালে প্রথমে প্লানিং এবং পারচেজ বিভাগে চাকুরি শুরু করি। এর পর মার্কেটিং, সাপ্লাই চেইন সহ অন্যান্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। আমি ২০০৮ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলাম। এখানে জয়েন করার আগে আমি আরও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজে করেছি।

আমার ক্যারিয়ারে দেখেছি, মেয়েদের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। কাজের প্রয়োজনীয়তায় ছেলেদের মত মেয়েদেরও অনেক সময় রাতে অফিস থেকে বের হতে হয়। অফিসের নিজস্ব পরিবহন না থাকলে নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। প্রথম দিকে আমি যখন এ প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি তখন নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থানা থাকায় রিক্সা ব্যবহার করতাম। অনেক সময় রাতে কাজ শেষ করে রিক্সায় বাসায় আসতে ভয় পেতাম। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই একজন নারীকে এগিয়ে যেতে তাদের বাইরে চলাচলের সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। রাস্তায় কোন নারী হেনস্তার শিকার হলে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলে রাস্তায় নারীরা নির্ভয়ে চলতে পারবে। এর ফলে তারা আরো বেশি সামনে এগিয়ে আসতে পারবে। আমাদের সমাজে আগে এসিড নিক্ষেপের পরিমান অনেক বেশি ছিল। বিভিন্ন পদক্ষেপের কারনে এখন তা নিয়ন্ত্রনে এসেছে। এখন আমরা যদি একজন ইভটিজার ও শ্লীলতাহানির অপরাধীকে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতে পারি তাহলে এসব অপরাধও অনেক কমে আসবে।

প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে নারী উদ্যোক্তারা বর্তমানে যে সব সমস্যামোকাবেলা করছেন?

রূপালী চৌধুরী : ঋণ পাবার জন্য প্রয়োজনীয় জামানত দিতে না পেরে অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যাবসা বড় করতে পারছে না। পাশাপাশি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে।

প্রশ্ন: বার্জার’র নতুন বিনিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা?

রূপালী চৌধুরী: আমরা সব সময়ই নতুন পণ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি। আপনারা জেনে থাকবেন দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে আমরা একটি শিল্প প্লট নিয়েছি। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে প্লটটি হস্তান্তর করেছে। আমরা সেখানে একটি আধুনিক পেইন্ট কারখানা স্থাপন করতে চাই। আমরা প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা ব্যায়ে আগামী ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে এই কারখানাটি স্থাপন করব বলে পরিকল্পনা করেছি। উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান এর মাধ্যমে এই নতুন কারখানাটি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে বলে আমরা আশা করি।

১ টি মতামত “নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে অবকাঠামো নির্মাণ- রূপালী চৌধুরী”

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.