অস্থির ডলার বাজার কমছে প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ
শাহ আলম নূর: অস্থির ডলার বাজারের প্রভাব পড়েছে প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি, অর্থাৎ প্রবাসীরা সরকারের তিনটি বন্ড কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে তাঁরা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বন্ড ভাঙছেন বেশি। সরকার বন্ডে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়ায়, নবায়নের সুবিধা উঠে যাওয়ায় এবং অস্থির ডলার মার্কেটের ধাক্কায় বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ডলার বাজারের অস্থিতিশীলতার মধ্যে প্রিমিয়াম বন্ডের মুনাফার হার কমানোয় সরকারি তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের নিট বিনিয়োগ ৪৯ মিলিয়ন ডলার কমেছে।
ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল প্রবাসীরা বন্ডে বিনিয়োগ না করে সঞ্চিত অর্থ আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, বাংলাদেশিদের কাছে কম-রিটার্নের বন্ডে বিনিয়োগের চেয়ে এই আড়াই শতাংশ প্রণোদনাকে বেশি লাভজনক মনে হয়েছে।
প্রবাসীদের জন্য তিনটি বন্ড সেভিংস স্কিম রয়েছে— ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড। তিন থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়া সাপেক্ষে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই বন্ড তিনটিতে সাড়ে ৬ শতাংশ ১২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যেত। কিন্তু এরপরই সুদের হার গড়ে ৪৪ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা বলছেন প্রবাসীদের বন্ডে বিনিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা বর্তমান ডলার রেটে সুবিধা পাবেন নাকি বিনিয়োগকালীন রেট পাবেন, তা স্পষ্ট নয়।
তারা বলছেন দেশের ডলারের তুলনায় টাকার মান কমছে। গত দেড় বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২৩ টাকা। এই সময়ে প্রবাসীরা আশঙ্কায় ছিলেন কোথায় বিনিয়োগ করলে তাদের জন্য ভালো হবে। যেহেতু নিয়মিত ডলারের দাম বাড়ছে, তাই তারা বন্ডে বিনিয়োগ না করে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এছাড়া অনেকে বিদেশেই বিনিয়োগ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগ ও এর মুনাফা স্থানীয় মুদ্রা টাকায় নেওয়ার সুযোগ আছে। আর ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মেয়াদ শেষ হলে বিনিয়োগ ডলারে নিতে হয়। এই দুটি স্কিমে প্রবাসীদের বিনিয়োগ শুরুর দিনে দেশের বাজারে ডলারের রেট অনুযায়ী টাকায় রূপান্তর করে বিনিয়োগ দেখানো হবে। বন্ডের মেয়াদ শেষ হলে এর সঙ্গে তার সুদ যোগ হবে।
প্রবাসীদের বন্ডে বিনিয়োগ কমার বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ার প্রভাব দেশের প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগে পড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সুদ কমার কারণে বন্ডে বিনিয়োগ কমেছে, এমনটি নয়। তার মতে, বন্ডে বিনিয়োগ কমার মূল কারণ ডলারের বাজারের অস্থিরতা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রি কমেছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার। তার আগের বছর এ বন্ডের নিট বিক্রি ছিল ১০৭ মিলিয়ন ডলার; ২০২০ সালে ছিল ১৩৫ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ ও ২০১৮ সালে এ বন্ডের নিট বিক্রি ছিল যথাক্রমে ১২৫ মিলিয়ন ও ২০০ মিলিয়ন ডলার।
ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রিও কমেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বন্ডটির নিট বিক্রি ছিল ঋণাত্মক ১৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালেও এ বন্ডের নিট বিক্রি ছিল ঋণাত্মক ৯ মিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২০ সালে নিট বিক্রি ছিল ২২ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ ও ২০১৮ সালে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রি ছিল যথাক্রমে ২৫ মিলিয়ন ও ২২ মিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২.১৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এ বন্ডের নিট বিক্রি ছিল ০.২ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ছিল ঋণাত্মক ১ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ ও ২০১৮ সালে এ বন্ডের নিট বিক্রি ছিল যথাক্রমে ১.৯৫ মিলিয়ন ও ৩৬ মিলিয়ন ডলার।
দেশে ১৯৮৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড এবং ২০০২ সালে তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড চালু করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এর বিদেশি শাখাসমূহ, এক্সচেঞ্জ হাউস, এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও স্থানীয় অনুমোদিত ডিলারদের (যেসব ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে) কাছ থেকে এসব বন্ড কেনা যায়।
এই তিনটি বন্ডের মুনাফা আয়করমুক্ত। আবার বন্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার সুযোগও আছে। এছাড়া এসব বন্ডে একাধিক মেয়াদে বিনিয়োগ করার সুবিধা রয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, করোনা মহামারির আগে এসব বন্ডে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা ছিল। তখন বিনিয়োগেও কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত ছিল না।
কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সরকার তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের জনপ্রতি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ১ কোটি টাকায় বেঁধে দেয়। এছাড়া এসব বন্ড কেনার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র থাকাটাও বাধ্যতামূলক করা হয়।
২০২২ সালের এপ্রিলে এই বিনিয়োগ সীমা তুলে দেওয়া হয়ে। কিন্তু সেইসঙ্গে সুদের হারও প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলা হয়। গত বছর জাতীয় পরিচয়পত্রের বাধ্যবাধকতাও আবার উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে এখন ৯ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়, আগে সুদ পাওয়া যেত ১২ শতাংশ। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে এখন ৩.৫ শতাংশ সুদ দেওয়া হয়, আগে সুদ দেওয়া হতো ৭.৫ শতাংশ। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে এখন ৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়, আগে পাওয়া যেত ৬.৫ শতাংশ।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগে সুদের হার কম থাকায় প্রভাব পড়েছে। তারা এখন এসব বন্ড জনপ্রিয় করার জন্য বিদেশে রোড শো করার পরিকল্পনা করছেন।