খুলতে পারছেনা ঋণপত্র
মেডিকেল সরঞ্জাম’র বাজারে হাহাকার
শাহ আলম নূর : ডলারের সংকট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল সরঞ্জাম’র বাজারে। আমদানিনির্ভর চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় এসব পণ্যের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। এসব পণ্যের ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যাদের কাছে আগের কিছু জিনিস আমদানি করা ছিল তারা ৪ থেকে ৫ গুণ দামে বিক্রি করছেন এসব পণ্য। গত ৪ মাস ধরে এসব পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংক থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, কার্ডিয়াক পেসমেকার, কৃত্রিম হার্ট ভালভ, ডিজিটাল রক্তচাপ মনিটর ও ডিভাইস, শ্রবণ সহায়ক ডিভাইস, রক্তের ব্যাগ, প্রস্রাবের ব্যাগ, ডায়ালাইজার টিউব, মেডিকেল ভেন্টিলেটর ও ডিজিটাল থার্মোমিটার। নিউরো সার্জারির জন্য ক্ল্যাম্প, কিউরেটস, ড্রিল বিট ও ইমপ্যাক্টর, এলিভেটর ও স্প্রেডার, হুক ও প্রোব, রিট্র্যাক্টর, কাঁচি, স্প্যাচুলা ও সাকশন টিউব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব ইকুইপমেন্ট সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইউএসএইড-এর প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বছরে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের। যার ৮৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও এ পর্যন্ত এই খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশে এই পণ্যের বিশাল বাজার থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশের জোগান আসে এসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারে নীতি সহায়তা পেলে দেশের চাহিদার বড় একটি অংশের জোগান তাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব। দেশে শুধুমাত্র ইনজেকশন সরঞ্জাম ও কিছু নিরাপত্তামূলক যন্ত্রপাতি উৎপাদন হয়। বাকি সব ধরনের সাধারণ ও উচ্চপ্রযুক্তির (হাই-টেক) মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানি করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে জন্মগত হৃদরোগ (হার্টে ছিদ্র) ধরা পড়ে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বালুয়া গ্রামের ১২ বছরের শিশু নজরুল ইসলাম পলাশের। ২৩ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের পর চিকিৎসকরা জানান, পলাশের সার্জারি করতে হবে। চিকিৎসকেরা তার বাবা-মাকে এজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। একটি অক্সিজেনেটরসহ বেশ কিছু সার্জিকেল ডিভাইস কিনতে বলা হয় তাদের।
কিন্তু পলাশের বাবা মোখলেসুর রহমান অক্সিজেনেটরের ব্যবস্থা করতে না পারায় এখনও তার সার্জারি করা যায়নি। বাইপাস সার্জারির সময় অক্সিজেনেটের হার্টের কাজ করে। এর মূল কাজ কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরিয়ে রক্তে অক্সিজেন দেওয়া।
ডিডব্লিউবি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আব্দুস সালাম বলেন, মোখলেসুর ৫ জুলাই অক্সিজেনেটর প্রি-অর্ডার করার পর থেকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় অক্সিজেনেটর আমদানি সম্ভব হয়নি।
সালাম জানান, এরকম প্রায় ৩৫৪টি অক্সিজেনেটরের প্রি-অর্ডার রয়েছে তাদের কোম্পানির কাছে। গত সাত মাসে একটি এলসিও খুলতে না পারায় সেগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব অক্সিজেনেটর সাধারনত চীন, তাইওয়ান, ও জাপান থেকে আমদানি করা হয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট-সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে সেখানে প্রায় ৩০০ জন রোগীর হার্টের বাইপাস সার্জারি, ওপেন হার্ট সার্জারি, ভালভ রিপ্লেসমেন্টসহ বিভিন্ন অপারেশন হয়। কিন্তু অক্সিজেনেটরের অভাবে গত জুলাই মাস থেকে সেখানে প্রতি মাসে মাত্র ২০-৩০ জন রোগীর অপারেশন হচ্ছে।
হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সরবরাহকারীরা আমাদের লিখিত দিয়েছে, আপাতত অক্সিজেনেটর দিতে পারছে না। কবে নাগাদ দিতে পারবে, তা-ও নিশ্চিত করেনি।’
হার্টের বাইপাস সার্জারিসহ যেকোনো অপারেশনের জন্য সব রোগীরই অক্সিজেনেটর লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে শুধু বয়ষ্ক কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সার্জনরা ‘বিটিং হার্ট’ পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু জরুরি সার্জারি করছেন। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সার্জারি পুরোই বন্ধ।”
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, শুধু অক্সিজেনেটর নয়, ডলার সংকটের কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে না পারায় গত বছরের নভেম্বর থেকে হার্টের ভালভ, পেসমেকার, রিং, হার্টের স্টেন্ট ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে পারছে না। এতে হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, নিউরোসার্জারি, কিডনি সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্জারিগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
চিকিৎসকেরা বলেন, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের প্রায় ১৫টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের জন্য অপারেশনের কার্যক্রম ব্যাহত গত সাত মাস ধরেই।
দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ থেকে ১২০টি ভালভের প্রয়োজন হয়। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া বেশিরভাগ হাসপাতালে ভালভ রিপ্লেসমেন্টের কাজ বন্ধ রয়েছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন চিকিৎসক বলেন, সব হাসপাতালেই প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে, তাই তারা রোগীদের বাড়িতে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি বলেন, অনেক রোগী আছে যাদের অবিলম্বে ভালভ রিপ্লেসমেন্ট প্রয়োজন হয় এবং তাদের অনেকের ভালভ দ্রুত প্রতিস্থাপন করা না হলে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু ভালভ সংকটের কারণে অনেক রোগীর চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।
ভালভ, পেসমেকার, রিং, ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট আমদানি ও সরবরাহ করে লিডিং ইলেক্ট্রো মেডিকেল।
কোম্পানিটির একজন পরিচালক বলেন, ‘এখন দুই দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশে এলসি খোলাটা কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়া প্রিন্সিপাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর মাসে আমরা যে এলসি খুলেছিলাম, সে মালামাল চলে এসেছে। প্রিন্সিপাল কোম্পানি কাগজপত্র জমা দিয়েছে, কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার না থাকার কারণে পেমেন্ট দিতে পারছে না।’
তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতে তাদের কিছু পণ্যের একটি চালান এসেছিল। আগে প্রতি মাসে কয়েকটা করে এলসি খোলা হতো। প্রতি বছরে প্রায় ২০ লাখ ডলারের ইকুইপমেন্ট আমদানি করা হতো। কিন্তু গত ৪-৫ মাস ধরে এলসি খোলা পুরোপুরি বন্ধ আছে। ফলে এখন তারা পুরো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
‘ভেবেছিলাম জানুয়ারি থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না। প্রতিদিন ব্যাংকের সাথে কথা বলি, কিন্তু ব্যাংক জানায় ডলার নেই। আগে হাসপাতালগুলোকে আমাদের পণ্য নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতাম। এখন হাসপাতালগুলো রোগীদের আমাদের নাম্বার দিয়ে দিয়েছে ভালভ, পেসমেকার আসছে কি না খোঁজ নিতে। রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা প্রতিদিন আমাদের ফোন দিচ্ছেন, আমরা তাদের কোনো আশার কথা বলতে পারছি না। হাসপাতালে চাহিদা আছে কিন্তু আমরা সরবরাহ দিতে পারছি না।’
এ বছরের ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ঔষধ প্রশাসন মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমতি প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়। ওই চিঠির একটি অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ডিসেম্বর মাসে আবেদনে জানিয়েছে যে আমদানিকারকগণ গত নভেম্বর থেকে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক হতে এলসি খুলতে পারছেন না।
কিন্তু নিত্যপণ্য আমদানি করার জন্য এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত মেডিকেল ডিভাইস নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এলসি সমস্যার কারণে সব ধরনের আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ করে দিতে। তাদের সাথে দ্রুত বসে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সাবেক স্বস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, এসব মেডিকেল ডিভাইস, ইকুইপমেন্টকে নিত্যপণ্য বিবেচনা করে সরকারের উচিত যেসব প্রতিষ্ঠান এসব ডিভাইস ও ইকুইপমেন্ট আমদানি করে, তাদেরকে বিশেষভাবে এলসি খোলার সুযোগ করে দেওয়া।
তিনি বলেন, এসব ডিভাইস আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিনিময়ে এসব ডিভাইস আনার জন্য উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিকেল ডিভাইসের চাহিদা রয়েছে। শতকরা ৭০ ভাগ চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আইটেমগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই নিষ্পত্তিযোগ্য। কিছু অর্থোপেডিক পণ্য, অস্ত্রোপচারের জীবাণুনাশক, হাসপাতালের আসবাবপত্র, হোম কেয়ার ডিভাইস, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম এবং অন্য ছোট যন্ত্র উৎপাদন করা হয় দেশে, যদিও তা স্বল্প পরিসরে।
বাংলাদেশ ইনডেন্টিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার, যেমন হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, নিউরোসার্জারি, কিডনি অপারেশন, অর্থপেডিক সার্জারিসহ প্রায় সব ধরনের সার্জারির জন্য বিদেশ থেকে প্রায় ১০০ ধরনের ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এলসি সংকটের কারণে নতুন চালান আমদানি করতে না পারায় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন মজুত করা কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এলসি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছরের মে-জুন মাসে ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।