ভূ-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘বর্তমান ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করতে হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের অর্থনীতির যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে।’
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারিখাতের দৃষ্টিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বক্তারা।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তারের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহসিনা ইয়াসমিন।
এছাড়া সেমিনারে নির্ধারিত আলোচনায় অংশে নেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এবং পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক (ফিন্যান্স ও অ্যাডমিন) মোহাম্মদ আলী হোসেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ নিয়ে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। তবে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে, বিশেষ করে এলডিসি পরবর্তী সময়ে রপ্তানি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে ভ্যালু অ্যাডিশনের ওপর আরও বেশি হারে জোর দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের (সহযোগী শিল্প) দক্ষতা বাড়াতে আরও বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
বাণিজ্যসচিব বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে রপ্তানির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী পণ্যের বহুমুখীকরণ একান্ত অপরিহার্য।মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে দেশের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরে সরকারের একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও বেসরকারি খাতের কার্যকর সমন্বয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিডার সচিব মোহসিনা ইয়াসমিন বলেন, বিডার ওয়ান স্টপ পোর্টালের মাধ্যমে বর্তমানে ১৮টি সেবা অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে এবং আগামীতে ৪০টি সংস্থার প্রায় ১৫০টি সেবা এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেওয়া হবে।
আমাদের উদ্যোক্তাদের এ ধরনের সেবা নেওয়ার হার খুবই কম, যার ফলে সেবাপ্রাপ্তিতে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা নিরসনে বিডা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না। তিনি উদ্যোক্তাদের বিডা পোর্টাল ব্যবহার করে অনলাইনভিত্তিক সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এবং পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক (ফিন্যান্স ও এ্যাডমিন) মোহাম্মদ আলী হোসেন অংশ নেন।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক নয়, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বৈশ্বিক ও স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতি কতটা সক্ষম তা নির্ধারণে নিজেদের হোমওয়ার্ক জরুরি।
ড. রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা প্রভৃতি সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়গুলো আমাদের সামাজিক খাত, বিশেষ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলেছে, যা মোকাবিলায় সবাইকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো (এসইজেড) আমাদের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তাই সব সেবার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যথাসময়ে এগুলোর কার্যক্রম শুরু করার প্রতি সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ওপর আরও বেশি জোর দিতে হবে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আসবে। যা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতিসহ সর্বোপরি জনজীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। খেলাপি ঋণ পরিমাণ কমাতে তিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং খেলাপি ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, আমাদের বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তারা অত্যন্ত উদ্যোমী। তবে প্রয়োজন সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা। এছাড়া ঘন ঘন শুল্ক বিধিমালা পরিবর্তন না করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার সেমিনারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের ওপর মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
মূল প্রবন্ধে তিনি স্থানীয় অর্থনীতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব, এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ, জাতীয় বাজেট ও মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।
এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে রপ্তানি সম্প্রসারণে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং সম্ভাবনাময় দেশ ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক ব্লকগুলোর সঙ্গে পিটিএ ও এফটিএ সই ত্বরান্বিতকরণ, ব্যবসা-বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় সংস্কার সহ প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেন তিনি।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া ডিসিসিআই সভাপতি বৈদেশিক বিনিয়োগে বহুমুখীকরণ, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের ভ্যালু অ্যাডিশন ৯০ শতাংশে উন্নীতকরণ, ওষুধ শিল্পের জন্য এপিআই শিল্পপার্কের দ্রুত বাস্তবায়ন, হালকা-প্রকৌশল শিল্পের জন্য পৃথক শিল্পাঞ্চল বৃদ্ধি কল্পে এবং পাট পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য নগদ সহায়তার প্রস্তাব করেন।
সিএমএসএমই হতে ‘মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ’কে পৃথক করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা আরও সহজে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।