ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে: ভবিষ্যতে চোখ বাংলাদেশের
নিজস্ব প্রতিবেদক : খুব বেশি আগের কথা নয়, বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ১৯৯১ সালে এদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৯ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়কালে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যাও ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ১১.৯ শতাংশ হয়েছে। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব না হলে দারিদ্র্যের হার আরও অনেক কমত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর, ১৯৭৬ সালে ছোট্ট একটি ট্রেডিং কোম্পানি নিয়ে ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু করেন মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল। এর ১৩ বছর পর নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ছোট একটুকরো জমিতে নিজের প্রথম কারখানা মেঘনা ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড স্থাপন করেন তিনি।
পরের দুই দশকে মোস্তফা কামাল আরও কয়েকটি কারখানা স্থাপন করেন। এর পরের দশকে তিনি প্রায় ৩০টি কারখানা স্থাপন করেন। এর সুবাদে মেঘনা গ্রুপ হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। ২০২০ সালে মহামারির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কামাল নয়টি নতুন শিল্প ইউনিটে ৪৫১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন, বিস্তৃত করেন মেঘনা গ্রুপের সাম্রাজ্য।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজে এখন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কর্মরত। গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৩০-৪০টি শিল্প ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছে এবং হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, এমন অন্যান্য বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আছে স্কয়ার গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, বসুন্ধরা, টিকে গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, এসিআই এবং ওরিয়ন গ্রুপ।
আরও অনেক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট কোম্পানি আছে যারা শূন্য থেকে শুরু করে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নোমান গ্রুপের কথা। এ গ্রুপ নিটওয়্যার, ওভেন পোশাক, ডেনিম, হোম টেক্সটাইল ও অ্যাকসেসরিজ উৎপাদন করে। বছরে তারা ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে। হা-মীম গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, এনভয় টেক্সটাইল, প্যাসিফিক জিনস, মোহাম্মদী গ্রুপ, ফকির অ্যাপারেলসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে ফেলবে।
কিন্তু খুব বেশি আগের কথা নয়, বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ১৯৯১ সালে এদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৯ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়কালে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যাও ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ১১.৯ শতাংশ হয়েছে। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব না হলে দারিদ্র্যের হার আরও অনেক কমত।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২২ সালে তা ৪৬০ বিলিয়ন ডলার পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে দেশের জিডিপির আকার পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাব এবং উন্নত অবকাঠামো। এ সময়ে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তার সঙ্গে ভোগবাদের বিকাশের ফলে বেড়েছে স্থানীয় ভোগব্যয়ও। এর সুবাদে বিকশিত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। এর প্রমাণ মিলেছে মহামারিকালেও। মহামারির সময় আন্তর্জাতিক অনেক অর্থনীতি যখন ধুঁকেছে, তখন তুলনামূলক ভালো ছিল বাংলাদেশ।
মহামারি ও যুদ্ধ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়ার সবগুলো মানদণ্ড পূরণ করেছে এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পথে আছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ এবং এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চের পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১ ট্রিলিয়ন ডলার হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের রহস্য কী?
গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—অর্থনৈতিক সংস্কার, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ক্ষুদ্রঋণ, উন্নত অবকাঠামো ও এদেশের মানুষের উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাব।
অর্থনৈতিক সংস্কার: ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে, যা বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। সরকার বেসরকারি খাতে ব্যাংকিং, নন-ব্যাংকিং আর্থিক পরিষেবা ও বিমা ব্যবসার অনুমোদন দেয়। এ সময় বিদেশি বিনিয়োগের ওপর থেকেও বিধিনিষেধ সরিয়ে নেয় সরকার। পাশাপাশি বাণিজ্য বাধা কমায় এবং কর হ্রাস ও অন্যান্য প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ জোগায়।
রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন: ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করে। ফলে টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও ওষুধের মতো শিল্পের বিকাশ ঘটে। এটি দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি বাড়াতে সহায়তা করেছে।
ক্ষুদ্রঋণ: ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নিজস্ব ব্যবসা শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ায় ও স্থানীয় চাহিদার প্রবৃদ্ধি ঘটায়, যা আজ দেশের বেসরকারি খাতের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উন্নত অবকাঠামো: বাংলাদেশ রাস্তা, সেতু ও বন্দরের মতো অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার, যা শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে সহজতর করেছে। বিশেষ করে পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল শিল্পগুলোর প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে সহজ হয়েছে এর ফলে।
বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ কেন আকর্ষণীয় গন্তব্য?
নানা কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—বর্ধনশীল স্থানীয় অর্থনীতি, অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে শুল্কমুক্ত রপ্তানি, উদ্বৃত্ত সস্তা শ্রম, উচ্চমানের পোশাকপণ্যের সুযোগ, ক্রমবর্ধমান কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত এবং ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতি।
এছাড়া দেশের মধ্যবিত্ত জনসংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশই মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। ২০২৫ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বা প্রায় ৪ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হবে, যা বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
সরকার দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। সবচেয়ে বড় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন)—নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দরের কাছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। বিএসএমএসএনের পাশাপাশি চারটি রাষ্ট্রচালিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২২ বিলিয়নের ডলারেও বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে ঝামেলামুক্ত জমি পেতে পারে। এছাড়াও জাপানি, ভারতীয় ও চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য ডেডিকেটেড অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে এবং ডেডিকেটেড অঞ্চলে জন্য অন্য যেকোনো আগ্রহী দেশকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়ে রেখেছে।
অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ বিপুল বিনিয়োগ করেলেও—২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জিডিপির প্রায় ৬.২ শতাংশ—ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য এখনও অনেক কিছুর প্রয়োজন। ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক হিসাব অনুসারে, অবকাঠামোগত চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এই চাহিদা বিদেশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রকৌশল পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রচুর সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, বৃহৎ অবকাঠামো, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ও সেবা খাতে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ বিশাল সুযোগের জায়গা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ঘাতসহ অর্থনীতি, যা যেকোনো খারাপ আবহাওয়া সহ্য করে টিকে থাকতে পারে।
‘আমাদের শুধু এমন মেগা প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যেগুলো আগামী ১০ বছরে একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।’
অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দক্ষতার খোঁজ করছে, এমন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগগুলোর জন্য বাংলাদেশ বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বসে আছে। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অথবা বহুজাতিক কর্পোরেশন যখন উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বাইরের কোনো দেশে বিনিয়োগ করে, সেটিই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। এই বিনিয়োগ কৌশল বাংলাদেশের সস্তা শ্রম, প্রযুক্তি, প্রযুক্তি, অনুকূল কর নীতি ও অবকাঠামোর সুবিধা পেয়ে থাকে।
ড. রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ এখন জনমিতিক লভ্যাংশে আছে। এই ক্রমবর্ধমান তরুণ উপার্জনকারী ও ভোক্তাদের সুবাদে দক্ষতা ও শ্রমঘন খাতগুলোর জন্য বাংলাদেশ আদর্শ বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানও এফডিআই গন্তব্য হিসেবে এদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
‘তবে এই সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে,’ শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন ড. মাসরুর।
তার মতে অন্যতম চ্যালেঞ্জগুলো হলো: নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করার জন্য নিয়ন্ত্রক পরিবেশের উন্নতি, সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি প্রণয়ন এবং পরিষেবাগুলোর আধুনিকীকরণ।