আজ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ইং, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার |

kidarkar

বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধায় যানবাহন চলাচলের বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির শিরোনাম হচ্ছে ‘প্রটোকল অব দ্য এগ্রিমেন্ট অন দ্য মুভমেন্ট অব ট্রাফিক ইন ট্রানজিট বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ভুটান’।

বুধবার (২২ মার্চ) ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

এরফলে বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশপথের অবকাঠামো ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধায় তৃতীয় দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে ভুটান।

এতে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়, অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে ও সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই যুগান্তকারী চুক্তি দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহজতর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে গত ১৪ মার্চ স্থলবেষ্টিত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানকে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সড়ক ও বন্দর ব্যবহারের একটি খসড়া চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভুটান একটি ল্যান্ড লকড কান্ট্রি। আমদানি-রপ্তানিতে তাদের নিজস্ব কোনো নদী বা সমুদ্র বন্দর নেই। সেইক্ষেত্রে তারা ভারতের কাছ থেকেও একই ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকে। এখন বাংলাদেশের বন্দর ও সড়ক ব্যবহারের সুযোগও তারা পাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভুটান যে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে তার বিপরীতে মাশুল পরিশোধ করতে হবে দেশটিকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরসহ বিশেষ বিশেষ অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আলোচনার মাধ্যমে মাশুল নির্ধারণ করবে।

বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ চুক্তির আওতায় ভুটান ট্রানজিট সুবিধা পেতে যাচ্ছে। যার ফলে দেশটি আমদানি-রপ্তানির প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারবে৷ এমন কি তারা জল, স্থল, রেলপথ, বিমান পরিষেবাসহ সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগও পাবে। ট্রানজিট সুবিধার আওতায় তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য ভুটানের গাড়িগুলো পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে বিমান ও সমুদ্রবন্দরে যাবে। এরপর এসব পণ্য বিশ্বের নানা দেশে পাঠানো হবে। বাংলাদেশের ওই একই অবকাঠামো ব্যবহার করে আবার আমদানি করা পণ্য ভুটানে পরিবহন হবে।

এক্ষেত্রে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করবে ভুটান। এছাড়া আকাশপথে পণ্য পরিবহনের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ আছে। এসব বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এমন সড়ক, রেলপথ ও নৌপথ খসড়া প্রটোকলে যুক্ত রয়েছে।

যে পাঁচ রুট ব্যবহার করে বাণিজ্য করবে ভুটান গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে তৃতীয় দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ভুটানকে বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে ট্রানজিট চুক্তির খসড়া ও প্রটোকল চূড়ান্ত করা হয়। এরপর সেটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন নেওয়া হয়।

খসড়া প্রটোকল অনুযায়ী সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য বাছাইকৃত রুটগুলো হচ্ছে
১. (ভুটান থেকে পণ্য নিয়ে) সামসি গোমটুফুয়েন্টসলিং  গেলেপু- বুড়িমারি- রংপুর- বগুড়া- হাটিকুমরুল- ঢাকা- চট্টগ্রাম। ২. ফুলবাড়ি-বাংলাবান্ধা-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-ঢাকা-চট্টগ্রাম। ৩. গেলেপু-তামাবিল-সিলেট-ঢাকা৷ ৪. গেলেপু-সামদ্রুপ-জংখর-তামাবিল-সিলেট-সরাইল-ঢাকা-বেনাপোল এবং (৫) সামসিগোমটুফুয়েন্টসলিংগেলেপু-নাকুগাঁও নালিতাবাড়ী-ময়মনসিং-ঢাকা।

সড়কপথে এই পাঁচটি রুট ছাড়াও রেলপথে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানির জন্য আরও দুটি রেলরুট যুক্ত করা হয়েছে খসড়া প্রটোকলে। এই রুটগুলো হচ্ছে
১. সামসি গোমটুফুয়েন্টসলিংগেলেপু-চিলাহাটি-সৈয়দপুর-পার্বতীপুর-সান্তাহার-ঈশ্বরদী-ভেড়ামারা-যশোর-নওয়াপাড়া-খুলনা-মোংলা। ২. চট্টগ্রাম-লাকসাম-কুমিল্লা- আখাউড়া-ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া-লালমনিরহাট-বুড়িমারি-সামসিগোমটু ফুয়েন্টসলিংগেলেপু।

এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে দুই দিনের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। দুই দিনব্যাপী বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ২০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এবং ভুটানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব দাশো কর্মা শেরিং ৯ সদস্যের ভুটানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) বাস্তবায়ন জোরদার করার লক্ষ্যে ট্রানজিট চুক্তি ও প্রটোকল চূড়ান্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্যোগ নেওয়া, পর্যটন শিল্পের বিকাশে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও ভুটান স্ট্যান্ডার্ড ব্যুরো (বিএসবি) এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (ডিএই) এবং ভুটান কৃষি ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

একই সঙ্গে বাণিজ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং সোনারহাট স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভুটান থেকে ভুটানি পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি পাথর আমদানি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে ভুটানের সচিব আশা প্রকাশ করেন যে আগামী দিনে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিকূলে। অর্থাৎ ভুটান থেকে আমরা বেশি আমদানি করি। বিপরীতে রপ্তানি করি কম। এই চুক্তির ফলে রপ্তানি বাড়বে। তবে দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ভুটানের সঙ্গে সম্প্রতি পিটিএ চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে করা এটাই বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ।

গত ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে পিটিএ স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ প্রথম এবং একমাত্র অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ করেছে ভুটানের সঙ্গে। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ১০০টি পণ্য ভুটানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে আর ভুটানের ৩৪টি পণ্য বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এবারের বৈঠকে চুক্তির আওতায় আরও কিছু পণ্য অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। দেশ দুটির বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয় ২০১২ সালে। ভুটান থেকে বাংলাদেশে সবজি ও ফলমূল, খনিজদ্রব্য, নির্মাণসামগ্রী, বোল্ডার পাথর, চুনাপাথর, কয়লা, পাল্প, রাসায়নিক আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভুটানে তৈরি পোশাক, আসবাব, খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, প্লাস্টিক ও বৈদ্যুতিক পণ্য রপ্তানি হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। গত ৫০ বছরে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর হয়েছে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.