আজ: শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪ইং, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার |

kidarkar

পুঁজিবাজার গতিশীল রাখতে বিএসইসির নানামুখী পদক্ষেপ

নিজস্ব প্রতিবেদক : নভেল করোনা নামক এক ভাইরাস আতঙ্কে পুরো বিশ্ব স্থবির। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার ‘পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি’ জারি করে। অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়, কোন কোনও ক্ষেত্রে হোম অফিস চালু করে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ সালের মে মাসে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রফেসর শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলাম। এ সময় পুরো কমিশন পুনর্গঠিত হয়। দায়িত্ব নিয়েই ঘুমন্ত পুঁজিবাজারকে জাগিয়ে তোলেন। এ সময় কমিশন পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার জন্য বড় বড় কর্মসূচি গ্রহণ করে। চলমান উদ্যোগের পাশাপাশি নতুন নতুন পদক্ষেন নেয়। তবে এ কাজ করতে নানা ধরণের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে কাজ করতে হয় কমিশনকে।

জানা গেছে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ শুরু করে। এতে পুঁজিবাজার উপকৃত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বাত্মক পারস্পরিক সহযোগিতায় সংকটময় পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার গতিশীল রাখার প্রয়াস নেয়।

বিএসইসি মনে করে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে সূচক বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বৈশ্বিক সংকটে দেশের পুঁজিবাজার অনেক ভালো আছে। এ সময়ে কমিশন এসএমই প্ল্যাটফর্ম, অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি), এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ), ট্রেজারি বন্ড, কমোডিটি এক্সচেঞ্জসহ নতুন নতুন প্রোডাক্ট পুঁজিবাজারে সংযুক্ত করেছে। ইতিমধ্যে এর সুফল বিনিয়োগকারীরা পেতে শুরু করেছে।

জানা গেছে, বিনিয়োগকারী এবং দেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখার স্বার্থে কমিশন করোনা পরিস্থিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনে পুঁজিবাজার খোলা রাখে। এ সময় উৎপাদন, বিপনন বন্ধ থাকা এবং সুদহার কমে যাওয়ায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ অলস টাকা শেয়ারবাাজরে বিনিয়োগ হয় এবং বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা পান।

এছাড়া কমিশন প্রাথমিক গণপ্রস্তাব প্রক্রিয়া (আইপিও) সহজীকরণসহ ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশেষ করে শেয়ার আনুপাতিক সমবন্টন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ ও এককভাবে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ না থাকা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন; সকল তফসিলি ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ; বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া বা নামমাত্র লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানিগুলোর নগদ লভ্যাংশ প্রদান নিশ্চিতকরণ; উৎপাদনে না থাকা কোম্পানিগুলোকে উদ্যোক্তা বা নতুন উদ্যোক্তাদের হাতে দিয়ে উৎপানমুখী করা; প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির একাধিক শাখার অনুমোদন; বিদেশে ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজের ডিজিটাল বুথ স্থাপন; বিশ্ব ব্যাংক ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রকল্পের আওতায় পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সার্বিক অটোমেশন প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণ (আইপিও অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন, ডেবট সিকিউরিটিজের জন্য অনলাইন ডাটাবেস, বিভিন্ন তথ্য অনলাইনে জমাদান, ইভোটিং, ই-এজিএম ইত্যাদি); বৈশ্বিক সংকটে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ; পুঁজিবাজারে সার্বিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম কঠোরতর করা; পুঁজিবাজারের ব্র্যান্ডিং এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই) বাড়াতে বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজন এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করে।

এছাড়া, মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর শৃঙ্খলা বৃদ্ধি ও লভ্যাংশ প্রদানের উদ্যোগ, বন্ড মার্কেট উন্নয়নে ইসলামী গ্রিন সুকুকের পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বন্ডেরও লেনদেন চালু, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা গণনায় শেয়ারের বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার- ২০২২ প্রদান, এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজীকরণ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠন ও স্ট্রাটেজিক পার্টনার নির্ধারণে সহায়তা, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ দিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) গঠন ও লভ্যাংশ ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ, ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখার কারণে স্তিমিত থাকা নতুন বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে আনতে নগদ লভ্যাংশ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি।

এছাড়া, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসকো) এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনালের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন।

সিএমএসএফের চেয়ারম্যান এবং সাবেক মূখ্য সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে কমিশন খুবই আন্তরিক। কমিশন দায়িত্বে নেওয়ার পর হারিয়ে যাওয়া পুঁজির সন্ধান করেন। দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের না পাওয়া লভ্যাংশ

বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্ধাবনী পদক্ষেপ নেয়। এজন্য সিএমএসএফ প্রতিষ্ঠা করে পুঁজি ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এটি শৃুধু বিনিয়োগকারীদেরই পুঁজি ফেরত দেয়নি, পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট মেটাতেও বড় ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের অর্থনীতিকে পরিচিত করতে বড় ভূমিকা রাখছে। এই কমিশন চ্যালেঞ্জিং সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ে। কিন্তু কমিশন সেটি সুন্দরভাবে কাজ করে গতিশীল রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রডাক্ট চালু করেছে।

ডিএসইর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, বাজারকে গতিশীল করতে বিএসইসির চেয়ারম্যান নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ডিলিস্টিংয়ে বড় ধরণের সংস্কার করেছেন। আগে কোন কোম্পানি তালিকাচ্যুত হলে বিনিয়োগকারীরা কিছুই পেতেন না। এক্ষেত্রে তিনি বোর্ড পুনর্গঠন করে কোম্পানি চালু করেছেন, যেগুলো এখন ভালোই চলছে। বন্ড মার্কেট চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। ডিএসইর ডিজাস্টার রিকাভারি ছিল না, সেটি চালু করেছেন। তিনি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করেছেন। এছাড়াও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) এবং সিসিবিএলের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন। এতে বাজার গতিশীল রয়েছে। তিনি এসএমনই বোর্ড চালু করেছেন, এতে ছোট মূলধনী কোম্পানি বাজারে আসার সুযোগ পেয়েছে।
বিএমবিএর প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

বিএসইসির নানামুখী কার্যক্রম ও উদ্যোগের ফলে পুঁজিবাজার গতিশীল হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন যেসব সমস্যা ছিল বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর তা দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছে। স্টেকহোল্ডারদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয়হীনতা ছিল তাও দূর করেছেন। বন্ড মার্কেটকে কার্যকর করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ মার্কেট চালু করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। দীর্ঘদিনের অনেক অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসা করেছে। আইপিও প্রক্রিয়া সহজতর করেছে।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মে বিএসইসির চেয়ারম্যার (সিনিয়র সচিব) হিসেবে পুঁজিবাজারের হাল ধরেন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে বিএসইসিতে কাজ যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন্স সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও সাবেক শিল্প সচিব আব্দুল হালিম। এছাড়া, তৎকালীন আরেক কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন খোন্দকার কামালুজ্জামান। পরে তার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন কমিশনার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. রুমানা ইসলামকে নিয়োগ দেয় সরকার।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.