সংকটেও ভালো করছে ব্যাংক খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০২২ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মুনাফা করার সুখবর দিয়েছে। বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা ও রেকর্ড পরিমাণের ঋণ পুনঃতফসিলের কারণে এই মুনাফা হয়েছে বলে ব্যাংকগুলো জানিয়েছে।
চলতি বছরে ডলার ব্যবসায় আয় কমে গেলেও ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে করে নিট সুদ আয় বেড়েছে। সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে। আর এতেই বেশিরভাগ ব্যাংকের নিট মুনাফা চলতি বছরও বাড়তে দেখা গেছে।
চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫ ব্যাংকের মধ্যে ২২টির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে। অবশিষ্ট ১৩টির মধ্যে ১১টির আয় কমেছে এবং দুটি লোকসানে রয়েছে। ব্যাংকগুলোর চলতি প্রথমার্ধের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।
আমানত নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকার পরও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির নিট মুনাফা হয়েছে ৩৪৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ৪ কোটি টাকা বেশি। ডলার ব্যবসায় ব্যাংকটির আয় কিছুটা কমলেও বিনিয়োগ ও অন্যান্য পরিচালন আয় বেড়েছে। এ সময় ডলার ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ২২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ কোটি টাকা কম। চলতি প্রথমার্ধে পুঁজিবাজার থেকেও ৫৩ কোটি টাকা আয় বেশি হয়েছে।
সুদ আয়, সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ ও ডলার ব্যবসাÑ সব খাতেই প্রবৃদ্ধি রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের। চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ২১ শতাংশ। সঞ্চিতি সংরক্ষণে ৪০ কোটি টাকা বাড়তি রাখতে হলেও চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে ১৯ শতাংশ।
নিট সুদ আয়ে ঋণাত্মক থাকলেও ডলার ব্যবসায় দ্বিগুণ আয় হওয়ায় পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮৬২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। এ সময় মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ আট গুণ বাড়লেও পরিচালন ব্যয় কমেছে ১৪১ কোটি টাকা, যা নিট মুনাফার প্রবৃদ্ধিতে থাকতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। চলতি প্রথমার্ধে রূপালী ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়েছে ৩৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮৩ শতাংশ।
কমিশন ও ডলারের ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি হলেও নিট সুদ আয় কমেছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের। এতে করে চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা কমেছে। সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণও সামান্য কমেছে। সবমিলিয়ে চলতি প্রথমার্ধে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নিট মুনাফা সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে।
চলতি প্রথমার্ধে নিট সুদ আয়ে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিটি ব্যাংকের। ডলার ব্যবসা কিছুটা কমলেও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকে আয় বেড়েছে। এতে করে ব্যাংকটির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে। যদিও এ সময় পরিচালন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি মন্দ ঋণে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণও বেড়েছে।
নিট সুদ আয় ও বিদেশি মুদ্রার ব্যবসা থেকে আয় কমলেও সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে আয় ব্যাপক হারে বেড়েছে ব্যাংক এশিয়ার। এর ফলে চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ১২ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় পরিচালন ব্যয় ১০২ কোটি টাকা বাড়লেও মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ কমেছে ১১৫ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
চলতি প্রথমার্ধে ডলার ব্যবসা থেকে ৩২ কোটি টাকা আয় কমেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের। তবে ঋণ, সরকারি সিকিউরিটিজ, পুঁজিবাজার ও অন্যান্য বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ায় পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে ব্যাংকটি। মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ সামান্য বাড়লেও চলতি প্রথমার্ধে নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও ডলারের ব্যবসায় লাভ কিছুটা কমলেও নিট সুদ আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের। এর ফলে চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণও কমেছে। এর ফলে চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।
ডলার ব্যবসা সংকুচিত হলেও সরকারি সিকিউরিটিজ ও নিট সুদ আয়ে ভর করে পরিচালন মুনাফা কিছুটা বেড়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের। একই সময় সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ কারণেই চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ায় পরিচালন মুনাফায় ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংকের। চলতি প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয় বাড়লেও কমেছে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ। এ কারণে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নিট মুনাফায় আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছে ব্যাংকটি। এর বাইরে প্রাইম, প্রিমিয়ার, পূবালী, এনসিসি, মিডল্যান্ড, যমুনা, আইএফআইসি, ফাস্ট সিকিউরিটি, এক্সিম, ঢাকা, ইউনিয়ন, এবি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা চলতি প্রথমার্ধে বেড়েছে।
এদিকে বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা বাড়লেও লোকসানে রয়েছে ন্যাশনাল ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এ ছাড়া মুনাফা কমেছে আল-আরাফাহ, এনআরবি কমার্শিয়াল, ডাচ্-বাংলা, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ওয়ান, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউসিবি ও উত্তরা ব্যাংকের।
ডলারের ব্যবসায় আয় কমলেও সুদ ও বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ায় পরিচালন মুনাফা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে উত্তরা ব্যাংকের। তবে চলতি প্রথমার্ধে মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ ২৪ কোটি টাকা বেশি রাখতে হওয়ায় নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে।
চলতি প্রথমার্ধে নিট সুদ আয়ের পাশাপাশি ডলার ব্যবসা থেকেও আয় কমেছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসির। বেশিরভাগ ব্যাংকের নিট সুদ আয় বাড়লেও এ সময় ইউসিবির ২১ কোটি টাকা কমেছে। সব মিলিয়ে চলতি প্রথমার্ধে পরিচালন আয় কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। বিপরীতে ১৬ শতাংশ বেড়েছে পরিচালন ব্যয়। তবে মন্দ ঋণের বিপরীতে রাখা সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ প্রায় ৬১ শতাংশ কমে যাওয়ায় নিট মুনাফায় ব্যাপক পতন থেকে রক্ষা পেয়েছে ব্যাংকটি। চলতি প্রথমার্ধে ইউসিবির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কমেছে।