সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের দাপট, জীবিকা নিয়ে শংকায় বনজীবীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে আবারও দাপট দেখাতে শুরু করেছে একাধিক বনদস্যু বাহিনী। প্রশাসনের টানা অভিযানে ২০১৮ সালে অধিকাংশ বনদস্যু আত্মসমর্পণ করলেও, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুরনো ও নতুন বাহিনীগুলো। মুক্তিপণের জন্য জেলেদের অপহরণ, চাঁদাবাজি, লুটপাট, এমনকি নির্দিষ্ট টোকেন ছাড়া মাছ ও কাঁকড়া আহরণ নিষিদ্ধ করে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তারা। ফলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার বনজীবী চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, শরীফ বাহিনী, মজনু বাহিনী, রবিউল বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, ভাই ভাই বাহিনী ও মামা-ভাগনে বাহিনী নামে কয়েকটি দস্যুদল সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১০ থেকে ২৭ জন পর্যন্ত এবং তারা আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত। খুলনা রেঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনী, কালাবগি, দাকোপ, কৈখালী, গাবুরা, মুন্সিগঞ্জসহ উপকূলীয় এলাকায় দস্যুরা অবাধে তাণ্ডব চালাচ্ছে।
জেলেদের অভিযোগ, সুন্দরবনে প্রবেশ করতে হলে আগে দস্যুদের নির্ধারিত টোকেন নিতে হয়। আটনের নৌকা থেকে ১০-১২ হাজার, দোনদড়ি নৌকা থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। পথে আটকালে ‘ডিউটি’ বাবদ আরও ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে নৌকা, জাল, মাছ, ডিজেলসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম লুটে নেওয়া হয়, এমনকি জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। চলতি গোলপাতা আহরণ মৌসুমেও প্রতিটি নৌকা থেকে ৫,০০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে দস্যুরা।
কয়েকদিন আগে কালাবগিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০-২২ জন জেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬-১৭ জন নির্ধারিত ২০-৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন, তবে এখনও ৪-৫ জন জেলে দস্যুদের হাতে জিম্মি রয়েছেন। জানা গেছে, এর মধ্যে দুইজনের মুক্তিপণের ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে এবং দুই-এক দিনের মধ্যে তারা মুক্তি পেতে পারেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, কালাবণি এলাকার কয়েকজন কথিত জেলে ব্যবসায়ী দস্যুদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করছে, যা তাদের আরও শক্তিশালী করছে।
বনজীবীদের মতে, প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় দস্যুরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শরিফুল ইসলাম জানান, “ভুক্তভোগী কেউ এখনও লিখিত অভিযোগ করেনি, তবে বিভিন্ন সূত্রে বনদস্যুদের সক্রিয় হওয়ার তথ্য পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
তবে স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসনের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। তারা মনে করেন, ২০১৮ সালের মতো আবারও যৌথ বাহিনীর (র্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশ) মাধ্যমে সুন্দরবনে বড় অভিযান চালানো না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হবে।
সুন্দরবননির্ভরশীল প্রায় পাঁচ লাখ বনজীবীর জীবন এখন হুমকির মুখে। উপকূলের শত শত পরিবার প্রতিদিন প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। শ্যামনগরের এক জেলে বলেন, “বিকল্প কোনো পেশা নেই আমাদের। সুন্দরবনে না গেলে না খেয়ে মরতে হবে, আর গেলে দস্যুরা অপহরণ করবে। এভাবে আর কতদিন চলবে?”
স্থানীয়দের মতে, বনদস্যুদের নির্মূল করতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌথ বাহিনীর অভিযান, স্থানীয়দের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং অভিযোগ গ্রহণের উপযুক্ত ব্যবস্থা ছাড়া এই সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে একসময়ের দস্যুমুক্ত সুন্দরবন আবারও ভয়ংকর আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হবে।