নন-লাইফ বীমা খাতে দাবির ৬৮% অনিষ্পন্ন, ক্ষতিপূরণ না পেয়ে দুর্ভোগে গ্রাহকরা

খালিদ হাসান : দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে মোট উত্থাপিত দাবির প্রায় ৬৮ শতাংশ বছরের শেষ পর্যন্ত অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। এর ফলে প্রায় ২,৬৩৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ ঝুলে রয়েছে, যা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অসংখ্য বীমাগ্রহীতা। অনেকে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে পড়েছেন চরম আর্থিক সংকটে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)–এর হালনাগাদ তথ্যমতে—২০২৪ সালে দেশের ৪৬টি সরকারি ও বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির কাছে মোট ৩,৫৮২.৮৯ কোটি টাকার দাবি উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১,৪৮১.৬৩ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ। বাকি ২,৬৩৫.২৬ কোটি টাকার দাবি থেকে গেছে অনিষ্পন্ন।
এক বছর আগের চিত্র ছিল আরও হতাশাজনক। ২০২৩ সালে মোট দাবি ছিল ৩,৮৭১.৯২ কোটি, যার মধ্যে পরিশোধ হয়েছিল মাত্র ১,২৩৭.৪০ কোটি টাকা। অথ্যাৎ ৩২ শতাংশ। দুই বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে দাবি নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত নিচে, যা পুরো খাতের ওপর আস্থার বড় সংকট তৈরি করছে।
আইডিআরএ জানিয়েছে, যেসব বীমা কোম্পানি দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে একটি গভর্নেন্স রিভিউ সভা খুব শিগগিরই আহ্বান করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, কোম্পানিগুলোর প্রধান অজুহাত হচ্ছে—রাষ্ট্রায়ত্ত পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারন বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি) সময়মতো তাদের দায় পরিশোধ করে না। ফলে বীমা কোম্পানিগুলোও গ্রাহকের কাছে ক্ষতিপূরণ পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। আইডিআরএ এসবিসিকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছে এবং জানিয়েছে যে, নতুন ব্যবস্থাপনায় এসবিসি দাবি নিষ্পত্তির ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের মোট পুনর্বীমার ৫০ শতাংশ এসবিসির মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ তারা বিদেশি পুনর্বীমাকারীদের মাধ্যমে করতে পারে। কিন্তু এসবিসির দায় মেটাতে দীর্ঘসূত্রতা, অতিরিক্ত কাগজপত্রের দাবি এবং অর্থ ছাড়ে বিলম্বের কারণে মোট দাবি নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়। বিদেশি পুনর্বীমাকারীরা তুলনামূলকভাবে দ্রুত দায় মেটালেও এসবিসির ধীরগতি পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
বেশ কিছু বীমা কোম্পানি নিজেদের সুনাম রক্ষায় নিজস্ব তহবিল থেকে দাবি পরিশোধ করে থাকলেও, এটি সবার জন্য সম্ভব নয় এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে টেকসই নয়।
অন্যদিকে, এসবিসি দাবি করছে, কোম্পানিগুলো অনেক সময় অসম্পূর্ণ কাগজপত্র জমা দেয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে বীমা প্রিমিয়াম পুরোপুরি আদায় না হওয়ায় তারা দাবি নিষ্পন্ন করতে পারে না।
তবে বীমা কোম্পানিগুলোর পাল্টা যুক্তি হলো—এসবিসি প্রায়ই চেকলিস্টের বাইরে অতিরিক্ত ডকুমেন্টেশন দাবি করে, যা অনেক সময় গ্রাহক জোগাড় করতে পারেন না, ফলে পুরো প্রক্রিয়াই আটকে যায়।
নন-লাইফ বীমা খাতে এমন অনেক দাবি রয়েছে যেগুলো পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টেশন ও প্রিমিয়াম পরিশোধ সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দাবি আদালতে বিচারাধীন, যা প্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।
আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, বীমা দাবির যাবতীয় তথ্য ও কাগজপত্র পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। বাস্তবে এই বিধান প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়, আর এর সরাসরি ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ বীমাগ্রহীতা।
বীমা বিশ্লেষকদের মতে, কাঠামোগত দুর্বলতা, স্বচ্ছতার অভাব এবং প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতির কারণে বীমা খাতে আস্থা ফিরছে না। এ অবস্থায় শুধুমাত্র নীতিনির্ধারণী পরিবর্তন নয়, বরং বীমা কোম্পানি, এসবিসি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা—তিন পক্ষের সম্মিলিত সমন্বয়ের মাধ্যমেই দাবি নিষ্পত্তির হার বাড়ানো সম্ভব।
অন্যথায়, নন-লাইফ বীমা খাত ক্রমেই গ্রাহকবিমুখ ও অকার্যকর হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর।