উন্নয়ন ব্যয় হ্রাস, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি; স্থিতিশীলতার ওপর জোর
২০২৫-২৬ বাজেট: মেগা প্রকল্প নয়, প্রাধান্য মৌলিক খাতে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই প্রথমবারের মতো প্রস্তাবিত বাজেটের আকার আগের বছরের তুলনায় ছোট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকুচিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি ব্যয় সুষম করা এবং বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা বিবেচনায় এনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও বাজেট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় নতুন বাজেটের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। ভার্চুয়াল এই সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা, বাণিজ্য ও খাদ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সভায় অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার প্রস্তাবিত বাজেটের একটি উপস্থাপনা উপস্থাপন করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি ধরা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা কম। ঘাটতির অর্ধেকের বেশি বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে এবং বাকি অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষ করে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় এই ঘাটতি ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। তা সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
নতুন বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে প্রায় ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। অন্যদিকে, উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হতে পারে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হতে পারে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের আমলে গৃহীত বহু মেগা প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলো বাতিল করায় প্রকল্পের সংখ্যা এবং উন্নয়ন ব্যয় উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ায় এবং রাজস্ব আয় প্রত্যাশিত মাত্রায় না বাড়ায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে বাজেটের আকার কমলেও সমাজে বৈষম্য হ্রাস এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে গুরুত্বারোপ করা হবে।
নতুন অর্থবছরে সরকারের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫.৫ শতাংশ, যা চলতি বছরের ৬.৭৫ শতাংশ থেকে কম। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি—সবকটি তাদের পূর্বাভাসে এই প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী হিসেবে উল্লেখ করেছে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা আগের মতোই ৬.৫ শতাংশে রাখা হচ্ছে, যদিও সর্বশেষ মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩৫ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বাস্তবায়নযোগ্যতা, ব্যয় সুষমীকরণ, রাজস্ব আহরণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বাজেটের এই কাঠামো দেশের বর্তমান আর্থিক বাস্তবতা বিবেচনায় একটি কৌশলগত ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।