৫৫টি মার্চেন্ট ব্যাংকের মধ্যে ৮-১০টা মার্কেট পরিচালনা করে: মাহবুব এইচ মজুমদার
মাহবুব এইচ মজুমদার এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের কমিটিতে থেকে এ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে মার্চেন্ট ব্যাংকের অবদান নিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমের সাথে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় পুঁজিবাজারে উন্নয়নে দেশের বিদ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি ভূমিকা পালন করছেন এবং এর প্রভাব বাজারের উপর কীভাবে পড়ছে সেসব বিষয় উঠে এসেছে। আলোচনার চুম্বক অংশ শেয়ারবাজারনিউজ ডটকমের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো:
শেয়ারবাজারনিউজ: যে সকল সিকিউরিটিজ হাউজ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবে। যদি হাউজগুলো ঋণ এবং সুদ মওকুফ করে তাহলে সে মওকুফের টাকার উপর ট্যাক্স দিতে হবে না। আর ১৫ শতাংশ বা নো ডিভিডেন্ড দিবে তাদের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ কর আরোপের সিদ্ধান্তও বাতিল করা হয়েছে। এনবিআরের এসব সিদ্ধান্তে শেয়ারবাজারে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা?
মাহবুব মজুমদার: এতে কোম্পানির উপর কোন প্রভাব পড়বে না। আর মার্কেটেও এর কোন প্রভাব নেই।
শেয়ারবাজারনিউজ: বাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর কি ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?
মাহবুব মজুমদার: বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণেই পুঁজিবাজারের পতন দীর্ঘায়িত হয়েছে। তাই বাজারের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেটা করতে পারে সেজন্য মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৬ দফা কর্মসূচী দেওয়া হয়েছে। সে ৬ দফার দিকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেতে হবে।
প্রথমত, সিকিউরিটজ হাউজে এক্সপোজার লিমিট গণনা নিয়ে যা বলা হয়েছে তা পরিবর্তন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) আর স্টেচুটরি রিজার্ভ রেশিও (এসএলআর) অনেক বছরে ধরে একই জায়গায় রেখে দিয়েছে। যা পরিবর্তন করতে হবে।
তৃতীয়ত, ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা ডায়রী দিয়েছিলো অর্থমন্ত্রনালয়ে। সেখানে বলা হয়েছিলো, ক্যাপিটাল মার্কেটে যে কোন কাজ করতে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থমন্ত্রনালয়, এনবিআর সেটা করে না। এ বিষয়গুলা যদি আমরা এডজাস্ট বা আইন প্রতিপালন না করি তাহলে মার্কেটে কোন প্রভাব পড়বে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ পর্যন্ত যা করেছে তার জন্য কমিশনের সাথে পরামর্শ করে নাই। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কমিশনের সঙ্গে আজই পরামর্শ করে তাহলে দেখেন আগামীকাল মার্কেট কি হয়।
শেয়ারবাজারনিউজ: স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স যে বন্ধ করলো আইডিআরএ। তাদের ইনভেস্টরদের যে ভোগান্তি হয়েছে তাতে মার্কেটের কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা?
মাহবুব মজুমদার: কোম্পানির যারা ইনভেস্টর তারা মালিকপক্ষ। সেটা একটা শেয়ার হোক বা এক কোটি শেয়ার হোক তারা সবাই কোম্পানির মালিক। ক্যাপিটাল মার্কেটের মূল কাজই হলো ব্যাপক সংখ্যক। ছোট ছোট লোকজন মার্কেটে যুক্ত হতে পারবে। তাছাড়া আমাদের দেশে ইসলামী চিন্তাধারার লোকজন বেশি হওয়ার কারণে মূল আগ্রহ হয়ে থাকে ডিভিডেন্ডের প্রতি। আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে ছিলো অনেক সুন্দর জায়গা। কোম্পানি লোকসান দিলেই মানুষ জান দিয়ে দেয়। দেশে এ ক্যাপিটাল মার্কেট অনেক গুরুত্ব রয়েছে অথচ এ ক্যাপিটাল মার্কেটকেই পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন ক্যাপিটাল বান্ধব হবে না, বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন পুঁজিবাজার বান্ধব হবে না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে।
শেয়ারবাজারনিউজ: অভিযোগ রয়েছে আমাদের দেশে সুদের হার অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন কি?
মাহবুব মজুমদার: ব্যাংক লোন তখনই দেয় যখন লোন দরকার। এলসি খুলতে মার্জিন দরকার সেক্ষেত্রে ব্যাংকে যাওয়া হয়। একটা কথার কথা আজকাল মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে জায়গা কিনছে। সে জায়গায় আলু চাষ করছে। আর আলুর বীজও কিনেছেন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। তাও বড় ধরনের ইন্টারেস্ট দিয়ে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই দেখেন না কত শতাংশ ব্যাংক ইন্টারেস্ট দেওয়া হচ্ছে। সে তুলনায় আমাদের দেশের ব্যাংক সুদ হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। এতে ব্যাংকগুলো যেমন শেষ হয়ে যাচ্ছে তেমনি ইনভেস্টররাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র লাভ হচ্ছে ক্যাপিটাল মার্কেট। দেখবেন অনেকেই বলছে মার্কেটের জন্য এটা করেছি সেটা করেছি। আসলেই কিছু করা হচ্ছে না। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মার্কেট বান্ধব না হয় তাহলে কোন প্রভাব পড়বে না। পৃথিবীতে যেতো ব্ল্যাস্ট হয়েছে এমন সব ঘটনার রেকর্ডই আমার কাছে আছে। তা যদি খতিয়ে দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার উল্টো পথে হাটে। এভাবে হলে তো জান শেষ হয়ে যাবে। এখন যদি আপনি আমি জান নিয়ে ব্যবসা করি তাহলে কত জানের মালিক হতাম।
শেয়ারবাজারনিউজ: ব্যাংকে অনেক টাকা অলস পড়ে আছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
মাহবুব মজুমদার: দেখেন ব্যাংকগুলো এক্সপোজার করতে পারবে না্, ক্যাপিটাল মার্কেটে ইনভেস্ট করতে পারবে না। কিন্তু ক্যাপিটাল নিয়ে বসে আছে। আর এ ক্যাপিটাল কোথা থেকে আসছে এ কাপিটাল মার্কেট থেকে আসছে। কিন্তু এ ক্যাপিটাল মার্কেটে্ই ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা ইচ্ছা তাই করছে।
শেয়ারবাজারনিউজ: প্রতি বছরের মত চলতি অর্থবছরে বিএসইসি অর্থমন্ত্রনালয়ের সাথে বার্ষিক কর্মসূচী নিয়ে চুক্তি করে থাকে। এ বছরও ১১ কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আরো ৮টি কোম্পানির অনুমোদন পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
মাহবুব মজুমদার: আসলে আইপিও কেন আসছে তা না বলে বলা যায় ভাল আইপিও কেন আসছে না। ভাল আইপিও আসার জন্য কোন শর্ত কি আছে? দেখুন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর মার্কেটে আসার জন্য কিছু আইন করেছে। যার জন্য তারা ক্যাপিটাল মার্কেটে আসছে না। যদি কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ক্যাপিটাল ৫০ কোটি টাকা হয় তাহলে তাকে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসার বাধ্যবাধ্যকতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে কিছুদিন আগে আইন করেছে তাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এ দেশে ব্যবসা করছে কিন্তু ক্যাপিটাল মার্কেটে আসছে না। তারা শুধু এ দেশে ব্যবসা করে বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। দেশের কোন উন্নতি করছে না। এখন যদি ভাল কোম্পানি আইপিওতে না আসতে দেয় তাহলে তো দুই নাম্বার কোম্পানি মার্কেটে আসতে থাকবে।
শেয়ারবাজারনিউজ: বাজারে মার্চেন্ট ব্যাংকের কার্যক্রম কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মাহবুব মজুমদার: ৫৫টি মার্চেন্ট ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ৮-১০টা কোম্পানি মার্কেট পরিচালনা করে থাকে। যা ইস্যু ম্যানেজারের জন্য খুবই জটিল কাজ। আর তাই এ জটিল কাজের জন্যই ভাল কোম্পানি মার্কেটে আসতে চায় না। যদি আইন ব্যবসা বান্ধব হয় তাহলে ব্যবসা পরিবেশ বাড়বে। গত পাঁচ বছরের ইতিহাস দেখা যায় ক্যাপিটাল মার্কেটে মাত্র ৭০-৭৫টির মত কোম্পানি আসছে। তার মধ্যে ১০-১২টা কোম্পানি খুব খারাপ করে ফেলেছে। যা ইস্যু মূল্যের নিচে নামছে তার মধ্যে আমাদেরও একটা নামছে। আমরা ৬টি কোম্পানিকে ইস্যু করেছি তার মধ্যে একটা ইস্যু মূল্যের নিচে নেমেছে। এখন ইস্যু মূল্যের নিচে কোন কোম্পানি নামে তাহলে সে বিষয়ে তদন্ত করা উচিত। সেটা নিয়ে ডিএসই হোক আর যেই হোক সে বিষয়ে তদন্ত করা উচিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থাদের উচিত যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন সবাইকে দেখানো।কিন্তু কখনই তদন্ত রিপোর্ট দেখানো হয় না। ইস্যু মূল্যের জন্য শেয়ারবাজারে এ দুর্দশা হয়েছে এর কারণটাই উল্লেখ করলে দেখা যাবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা আস্থা আসবে। কিন্তু তারা কিছুই করছে না। আর যদি কারণ না থাকে তাহলে এটাই বলতে পারেন বাজারের স্বাভাবিক গতির কারণে এর মূল্য ইস্যু মূল্যর নিচে নেমে এসেছে। ভাল সংখ্যক আইপিও চাই এটাই আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত। আর ভাল সংখ্যক আইপিও আসতে কি করতে হবে সেটা নিয়ে কাজ করবো আমরা্।
শেয়ারবাজারনিউজ: এজিএম নিয়ে যা হচ্ছে তা সর্ম্পকে কি বলা যায়।
মাহবুব মজুমদার: একটি কোম্পানির মূল জিনিসই হচ্ছে এজিএম। এ দিন কোম্পানির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ম্যানেজমেন্টদের পায়। কিন্তু সেদিনও কোম্পানি ম্যানেজমেন্টদের প্রশ্ন করা হয় না। ঠিক আছে বছরের ৩৬৫দিন আপনি যা করছেন তা ঠিক কিন্তু একটা দিন বিনিয়োগকারীদের কথা শুনতে হবে। তবে এটার জন্য তিনটা জিনিষ করতে হবে। প্রথমত, যে প্রশ্ন করবেন তা ৩ বা ৭ দিন আগে কোম্পানিকে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এজিএমে ডিএসই ও সিএসই থেকে ২ জন প্রতিনিধি পাঠানো উচিত। তৃতীয়ত, কোম্পানিতে যার বেশি শেয়ার আছে তার উচিত বেশি করে প্রশ্ন করা। কারণ কোম্পানির প্রতি তার অ্যানালাইসিস বেশি।
এ তিনটা জিনিষ বাস্তবায়ন করে তাহলে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে এজিএম হবে। না হলে এজিএম কর লাভ নাই।
শেয়ারবাজারনিউজ: কোম্পানির বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীরা এজিএম করতে বিমুখ কেন।
মাহবুব মজুমদার: এখন এজিএমে যদি কথা বলতে নাই দেয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা যাবে কেন। তবে ভাল একটা কাজ করছে এজিএমে যে উপহার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া এক উদ্যোগ নিয়ে বসে থাকলে তো আর হবে না। আরো উদ্যোগ নিতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির স্বাধীন পরিচালক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না।
৩৩১ কোম্পানিতে কমপক্ষে ৬০০জন স্বাধীন পরিচালক আছে। কিন্তু তারা কোন দিনই কোন কোম্পানির বিপক্ষে দ্বিমত পোষণ করেনি। তারা কোন দিনই কোন কোম্পানির অডিট পাশ করাতে বা অডিট নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেননি।
শেয়ারবাজারনিউজ: স্বাধীন পরিচালকদের কি কোম্পানি তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দিচ্ছে না?
মাহবুব মজুমদার: চমৎকার কর্পোরেন্ট গভর্ন্যান্স আইন হয়েছে। যেটা প্রথমে ছিল ইনফরমেশনাল. পরে ছিল অপশোনাল আর এখন মেন্ডেটরি।কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্যাপিটাল বান্ধব না হয় তাহলে কোন লাভ নাই। কারণ বাবাই যদি ছেলেকে ঠিক না করে। তাহলে তো ছেলে আর ঠিক হবে না। তারা সব সময় অভিভাবকদের কাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তেমনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের অভিভাবক। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এতো সুন্দর একটা গাইড লাইন হওয়ার পরও তা কার্যকারিতা হচ্ছে না কেন। একটামাত্র কারণ ভাল স্বাধীন পরিচালক পাওয়া যাচ্ছে না্। তার কারণ তাকে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে না্। কোম্পানি লোন নিবে, এলসি খুলবে তার জন্য সব জায়গায় সাইন করেই গ্যারান্টার হতে হবে। সে ৫ হাজার টাকা ফি পাবে তার জন্য সে তার সকল সম্পত্তি যুক্ত করবে। কিন্তু আইন অনুযায়ী স্বাধীন পরিচালক এটা করতে পারবে না। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ।
শেয়ারবাজারনিউজ/মু/রা