শেয়ার বাইব্যাকে ভারতের তিন কোম্পানি: ৬৬টির অচলাবস্থা থাকলেও আমাদের বাইব্যাক নেই
শেয়ারবাজার রিপোর্ট: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে পাওয়া এবং খারাপ পরিচালনা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন কর্তাদের অভিযোগের জবাব দিতে শেয়ার বাইব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের ইনফোসিস। নিজস্ব জমা তহবিল থেকে শেয়ারহোল্ডারদের হাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। বাজার থেকে নিজস্ব শেয়ার কিনে নিয়ে এবং ডিভিডেন্ড বাড়িয়ে এই বাইব্যাক চলতি ২০১৭-’১৮ অর্থবর্ষেই করা হবে। এর আগেও আরও দুই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, টিসিএস ও কগনিজ্যান্ট কোম্পানিও শেয়ার বাইব্যাক করেছে। ভারতের পুঁজিবাজারে বাইব্যাক প্রাকটিস থাকলেও আমাদের দেশে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে বাইব্যাক।
অথচ পুঁজিবাজারে অবস্থানরত ৬৬টি কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এছাড়া মূল মার্কেটে কোম্পানিগুলোর জন্য বাইব্যাক আইন তৈরির কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তা অন্ধকারে পড়ে রয়েছে।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকারসহ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গুরুদায়িত্ব পালন করছে। লাখো বিনিয়োগকারী তাদের কার্যক্রমে আস্থা ফিরে পেতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে সময়মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়া কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষতি হয়েছে তারদিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ মার্কেটে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এজন্য কোম্পানিগুলোর জন্য বাইব্যাক আইন প্রণয়ন করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার কিনে নেয়া উচিত বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
ওটিসির ৬৬টি কোম্পানির মধ্যে নিয়মিত হিসেবে হাতেগোনা ২-৩টির লেনদেন হচ্ছে। অন্য কোম্পানিগুলোর লেনদেনের কোনো খবর নেই। যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম অনিশ্চিয়তায় রয়েছেন।
জানা গেছে, শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসির সভাপতি জিয়াউল হক খন্দকার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ওটিসি মার্কেট উদ্বোধন করেন। মূল মার্কেট থেকে তালিকাচ্যূত করা দুর্বল মৌলভিত্তি জেড ক্যাটাগরি, দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ, বছরের পর বছর লোকসানে থাকা, লিস্টিং আইন ভঙ্গ ও ডিমেট না হওয়া কোম্পানিগুলোকে এর আওতায় আনা হয়। কিন্তু ওই মার্কেট সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর দুর্বল ভিত্তি আর লেনদেন প্রক্রিয়ার জটিলতায় বর্তমানে এ মার্কেট অচলাবস্থায় রয়েছে। এ জটিলতার জট না খোলা পর্যন্ত সমস্যা দিন দিন বাড়বে। ওটিসি মার্কেটে ক্রেতা পেতেও কষ্ট করতে হয়। মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয় করতে গেলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আসতে হয়। এরপরও শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে সময় নিচ্ছে কমপক্ষে দু’সপ্তাহ। যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
জানা গেছে, পৃথিবীর প্রধান প্রধান স্টক মার্কেটগুলোতে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য শতভাগ শর্ত পূরণ করতে না পারলে মূল মার্কেটের পরিবর্তে ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়। শর্তপূরণ করার পর এসব কোম্পানি মূল মার্কেটে ফিরে আসে। কিন্তু আমাদের দেশের মূল মার্কেটে থাকা কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করে ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এ মার্কেটে লেনদেনে আগ্রহী না। এছাড়া বিভিন্ন দেশে দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হলে এর উদ্যোক্তারা শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে শেয়ার বাইব্যাক করে নেয়।
এছাড়া এ ধরনের কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জ অবসায়ন ঘোষণা করে অবশিষ্ট সম্পদ আনুপাতিক হারে শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে ভাগ করে দেয়। কিন্তু এখানকার কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এ সেই ব্যবস্থা নেই। এমনকি বাই ব্যাকের কোনো প্রয়োগও নেই। ফলে ওসিটি মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের আটক টাকা ফিরে পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে।
এদিকে বছরের পর বছর পার হলেও থমকে আছে বাইব্যাকের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ। আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের সময় বেশ তোড়জোড় শুরু হলেও অদৃশ্য কারণে এগুলোর বাস্তবায়ন বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এতে একদিকে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছাতা হারাচ্ছে অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাইব্যাক আইনের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার ছয় বছর অতিবাহিত হলেও সংসদে পাসের অজুহাতে এ আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তবে এখনও একটি মন্ত্রি পরিষদ সভার কেবিনেটেই উঠেনি বলে জানা গেছে। এদিকে এ আইন না থাকায় ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। প্রিমিয়াম দিয়ে আইপিওর শেয়ার কিনে তা ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে আসায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে শেয়ার পুন:ক্রয়ের বিধান না থাকায় বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে মাত্রাতিরিক্ত দরে শেয়ার ছেড়ে দিয়েই খালাস হচ্ছে কোম্পানিগুলো। যদি বাইব্যাক আইন বাস্তবায়িত হতো তাহলে বিনিয়োগকারীরা আর্থিক ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারণী মহলের উদাসীনতা ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়,পৃথিবীর অনেক দেশে বাইব্যাক পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও দেশের বিদ্যমান কোম্পানি আইনে তা অনুপস্থিত। ২০১১ সালের শুরুর দিকে পুঁজিবাজারে বড় ধরণের বিপর্যয়ের পর সরকার কোম্পানি আইন সংস্কার করে বাইব্যাক অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটি কোম্পানি আইনের অংশ বলে বাইব্যাক মূলত কোম্পানি আইনে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে কোম্পানি পরিবর্তন করে বাইব্যাক ধারা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান কোম্পানি আইন সংশোধন করে ৫৮ ধারার পর ৩টি উপধারা সংযোজন করে তা সংসদে পাসের মধ্য দিয়ে বাইব্যাক নিয়ম চালু করা হবে বলে জানা যায়।
এদিকে বাইব্যাক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর ২০১১ সালের আগষ্টের দিকে এ আইনের চূড়ান্ত খসড়া প্রনয়ণ করা হয়। প্রণীত খসড়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি),বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনষ্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ(আইসিএমএবি), রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ(আরজেএসসি),দি ইনন্সিটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি),ইনষ্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ(আইসিএসবি) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মতামত জানায়। কিন্তু আজও তা বাস্তবে রুপ নিচ্ছে না। তাই পুঁজিবাজার তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এই আইন অনতিবিলম্বে প্রণয়ন করা দরকার বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ারবাজারনিউজ/ম.সা