রানাতুঙ্গা করলে প্রতিবাদ আর সাকিব করলে বেয়াদবি?
১৯৯৯, অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডিলেড ওভালে অদ্ভুতুড়ে এক নাটক, উত্তেজনা ছড়ালো খেলোয়াড়-আম্পায়ারের বাকবিতণ্ডায়। রস এমারসন ‘নো’ ডেকেছিলেন মুরালির বলে, সেটার প্রতিবাদেই দলবল নিয়ে মাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাস যাকে দর্পভরে ঘোষণা দিয়েছে নিজেদের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক হিসেবে।
খেলোয়াড় হিসেবে আউটস্ট্যান্ডিং কোন কীর্তি ছিল না রানাতুঙ্গার। তবে অধিনায়ক রানাতুঙ্গা অন্যরকম একজন ছিলেন, ক্রিকেট ইতিহাসে যাকে বলা যায় বিরল প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। বুক ভর্তি সাহসের স্ফুলিঙ্গ, কখনও সেই সাহসটাকে দুঃসাহস বলেও মনে হতো। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে দল নিয়ে মাঠ ছাড়াটা তো দুঃসাহসই! এই কাজগুলোই খেলোয়াড় রানাতুঙ্গার চেয়ে ‘অধিনায়ক’ রানাতুঙ্গাকে বড় করে তুলেছিল, নিজের সতীর্থ আর দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন তিনি তৈরী করে নিয়েছিলেন অসাধারণ নেতৃত্বগুণ দিয়েই।
২০০৬, ইংল্যান্ড-পাকিস্তান টেস্ট। অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার পাঁচ রান জরিমানা করেলন পাকিস্তানকে। প্রতিবাদে দলবল নিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ইনজামাম উল হক। ম্যাচে ইংল্যান্ডকে জরিমানা ঘোষণা করা হলো, টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটলো এমন ঘটনা, চলমান ম্যাচ থেমে গেল একপক্ষের বেরিয়ে আসায়। ইনজামামের কিছুই হয়নি, ড্যারেল হেয়ারের ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই টেস্টের পরে।
২০১৮, কলম্বো। শেষ ওভারের ধুন্ধুমার রোমাঞ্চ। পরপর দুটো বল ব্যাটসম্যানের কাঁধের ওপর দিয়ে গেল। দ্বিতীয়টায় নো-বলের সঙ্কেত দিলেন লেগ আম্পায়ার, কিন্ত প্রতিবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কান ফিল্ডারেরা। দুই আম্পায়ার মিলে কথা বলে বাতিল করে দিলেন নো বলের সিদ্ধান্ত। আসল নাটকটা শুরু হলো তখন। ক্যামেরায় ধরা পড়লো বাংলাদেশ দলপতি সাকিব আল হাসানের রাগান্বিত মুখটা। উত্তেজিত স্বরে কথা বলছেন চতুর্থ আম্পায়ারের সঙ্গে। গ্যালারিতে উন্মত্ত চিৎকার, মাঠেও খানিকটা উত্তেজনা।
এরমধ্যেই সাকিব ভিডিও অ্যানালিস্টকে বললেন দ্বিতীয় বলটার উচ্চতা দেখার জন্যে। সেখান থেকেও গ্রীন সিগন্যাল এলো। মুস্তাফিজের ঘাড়ের ওপরে ওঠা বলটাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করলেন না আম্পায়ার, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সাকিব হাত তুললেন, যে সঙ্কেতটা দেখালেন সেটার মানে- ‘চলে এসো’! বাংলাদেশের অধিনায়ক দলকে মাঠ ছেড়ে চলে আসার কথা বলছেন! আম্পায়ারের ভুল বা অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন বাংলাদেশী একজন অধিনায়ক! তার সামনে কাঁচুমাচু করছেন ফোর্থ আম্পায়ার, রাসেল অরনল্ড মাথা নীচু করে কিছু একটা বলছেন সাকিবকে, হয়তো খেলাটা শেষ করার অনুরোধ! একজন সাকিব আল হাসান, একজন বাংলাদেশী কলম্বোর প্রেমাদাসায় গর্জে উঠেছেন ভুল কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনেককাল আগে যেটা রানাতুঙ্গা করেছিলেন, ইনজামাম করেছিলেন!
ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সাকিবের কাজটাকে কখনোই সমর্থন করা যাবে না। মাঠ ছেড়ে উঠে আসাটা সমাধান নয়, হতে পারেনা। মাঠের বাইরে অনেককিছুই করা যায়, কিন্ত নিজেদের সামর্থ্যের জানানটা দিতে হয় মাঠের ভেতরেই, বাইশ গজে দাঁড়িয়ে। সেটা রিয়াদের হাত ধরে গতকাল করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সাকিব আর কি’ইবা করতে পারতেন বলুন? আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা ছাড়া?
প্রতিবাদ করে বা মাঠ ছেড়ে উঠে গিয়ে কি লাভ- এই প্রশ্নটা উঠতে পারে। চুপ থেকে কি লাভ হচ্ছিল? ভদ্রলোক হয়ে বসে থেকে কি লাভ? বারবার তো বঞ্চনার শিকারই হতে হয়েছে। মুলতান-মেলবোর্ন কিংবা মিরপুর, বারবার আম্পায়ারের বাজে সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয়েছে আমাদের। প্রতিবাদটা আরও অনেক আগে জানানোর কথা ছিল। বারবার আমাদের ওপরে অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আমরা মেনে নিয়েছি ভদ্রলোকের মতো। সংবাদ সম্মেলনে বলেছি, আমরা সব ভুলে গেছি। সবকিছু কি ভোলা যায়? এই ভুলে যাওয়াগুলো বারবার ফিরে এসেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে। কলম্বোতেও সেটাই হয়েছে। কিন্ত এবার আর চুপ করে থাকিনি আমরা, গর্জে উঠেছি, জানিয়ে দিয়েছি, চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার দিন শেষ!
রানাতুঙ্গা তার জীবনে কোনদিন অ্যাডিলেডের সেই ঘটনাটাকে ‘ভুল’ বলে স্বীকার করেননি। তার দৃষ্টিতে আম্পায়ার অন্যায় করেছিলেন, তিনি সেটার প্রতিবাদ করেছেন। ইনজামাম কখনও দল নিয়ে টেস্ট ম্যাচ ছেড়ে উঠে আসার জন্যে অনুতপ্ত হয়েছিলেন কিনা জানা নেই। অথচ সাকিব কিন্ত ম্যাচ শেষেই স্বীকার করে নিয়েছেন, এতটা অ্যাগ্রেসিভ হওয়াটা উচিত হয়নি তার। ম্যাচে উত্তেজনা ছিল, এরকম সময়ে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তগুলো রক্তে অ্যাড্রেনালিন রাশটা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তবুও দলপতি হিসেবে আরও বেশী শান্ত থাকা দরকার ছিল নিজের- এমনটাই জানিয়েছেন পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ আর সংবাদ সম্মেলনে। ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন ম্যাচ অফিশিয়ালদের শুনানীতেও। তবুও সাকিব অপরাধী?
কাজটা ভালো কিছু হয়নি। সাকিবের সমালোচনা হতেই পারে। কিন্ত কোনটা সমালোচনা আর কোনটা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ, সেটা বুঝতে পারাটা খুব জরুরী। সুনীল গাভাস্কার এমন কাণ্ডে আইসিসির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন, এমনটা ক্রিকেটে অনুচিত বলেও জানিয়েছেন। ১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গাভাস্কারকে আম্পায়ার আউট দেয়ার পর তিনিও তো নিজের সতীর্থকে নিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে! গাভাস্কার-রানাতুঙ্গারা করলে সেটা প্রতিবাদ, সাকিব করলে বেয়াদবি? তিনজাতির একটা টুর্নামেন্টে চারজন আম্পায়ারের সবাই স্বাগতিক- এটা কেমন নিয়মের মধ্যে পড়ে, বা নৈতিকতার মানদণ্ডেই বা এর অবস্থান কোথায়- এই প্রাশ্ন কেউ তুলেছে কি? সাকিবের দিকে আঙুল তোলা যায়, কিন্ত বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে কেউ আঙুল তুলছে না কেন?
আক্রমণাত্নক মানসিকতা ক্রিকেটে খুব দরকারী একটা বিষয়। প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার জন্যে, ওদের মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে অ্যাগ্রেশন থাকা লাগে। গতকালের শেষ ওভারটাই দেখুন না, সাকিবের সেই তুমুল প্রতিবাদের পরে শ্রীলঙ্কা দলটা কেমন মিইয়ে গেল! দারুন দুটো শর্ট বলের পরে উদানা আর বাউন্সার দেয়ার সাহসই করলেন না! স্কোরবোর্ড বলছে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছে ১৯.৫ ওভারে, মাহমুদউল্লা’র ছক্কায়। অথচ বাংলাদেশ আরও তিন বল আগেই ম্যাচটা জিতে বসে আছে দারুণ এক মাইন্ড গেমে জিতে, সেটা বোঝানোর সাধ্য তো বোবা স্কোরবোর্ডের নেই!
সৌরভ গাঙ্গুলির চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান ভারতে অনেক এসেছেন, আরও আসবেন। অধিনায়ক ধোনির কীর্তির কাছে ফিকে লাগবে সৌরভের অর্জনগুলো। হাল সময়ে কোহলিও তো কত আক্রমণাত্নক। কিন্ত সৌরভের নাম নিলে প্রতিবার লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে ওড়ানোর দৃশ্যটা আসবে। ভারত বিশ্বকাপ জিতেছে, ওয়ার্ল্ড টি-২০’তে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা ঘরে তুলেছে, টেস্টে এক নম্বর আসনটা অনেকবার পাকাপোক্ত করেছে। কিন্ত ভারতের ইতিহাসের সেরা অর্জনের একটা ফটো গ্যালারি তৈরী করতে যান আপনি, সৌরভের ওই খালি গায়ের ছবিটা আপনাকে শুরুর দিকেই রাখতে হবে। সেই সৌরভ, ভারতের ক্রিকেটের বদলে যাওয়াটা যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল। যিনি ভারতকে বিদেশের মাটিতে জিততে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই অ্যাগ্রেশনটা সাকিবের মধ্যেও আছে, সৌরভের চেয়েও অনেক বেশী পরিমাণে আছে। সেই অ্যাগ্রেশনটাই বাংলাদেশকে অজস্র ম্যাচ জেতাবে, সাকিবের অধিনায়কত্বে এভাবেই বাংলাদেশ জিতবে। একটা প্রসেস শুরু হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করতে শিখেছি, অন্যায়কে পায়ে মাড়িয়ে জিতেছি। এরপরেও আমরা হারবো, জিতবো, জিতবো, হারবো। একদিন আমরা ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জিতবো, বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলবো। সেদিন সাকিব হয়তো লাল-সবুজ জার্সিটা গায়ে মাঠে থাকবেন না, তবে সাকিবের এই অ্যাগ্রেশনটাই হবে সেইসব জয়ের মূলমন্ত্র!
লেখক: ক্রিকেট পাগলা এবং একজন সাকিবিয়ান_
রাকিবুজ্জামান সাগর রাজ
শেয়ারবাজারনিউজ/ম.সা