আজ: বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ইং, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৩ অগাস্ট ২০২২, বুধবার |

kidarkar

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই: গবেষণা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘ব্যাংকক পোস্ট’ এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির তুলনামূলক বিচার করেছেন ভারতের কর্ণাটকভিত্তিক গবেষক ও বিশ্লেষক জন রোজারিও। প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির তুলনামূলক বিচার করেছেন।
এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকলেও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় গত কয়েক মাস ধরে আলোচনায়। এই আলোচনার মধ্যে বিশ্লেষকরা বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোতে একই সঙ্গে সংকটের ইঙ্গিত খুঁজছেন। বাংলাদেশের মতো এমন অর্থনীতির কয়েকটি দেশকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, যেগুলোতে একটি ঋণ সংকট বা খারাপ পরিস্থিতি হয়তো দেখা দিতে পারে।
ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট সম্প্রতি ঋণ ঝুঁকিতে থাকা ২৫টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। রাশিয়া, জাম্বিয়া, সারিনেম, লেবানন ও কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ঋণ পরিশোধে পিছিয়ে রয়েছে। দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বেলারুশ। ১২টি অপর দেশ মূল্যস্ফীতি, ঋণ ও উচ্চ ঋণ ব্যয়ের তালিকায় রয়েছে। এগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, তিউনিসিয়া, ঘানা, মিসর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তাান, বেলারুশ ও ইকুয়েডর। এই তালিকায় নেই বাংলাদেশ।
কারণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অর্থনীতিকে সমান গতিতে রাখতে পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করা হয়েছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমানো হয়েছে, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে নগদ উপহার দেওয়া হচ্ছে, বিলাসবহুল পণ্যে করারোপ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে। যার ফলে আমদানির চাহিদা সহজে মেটানো যায়। এরই মধ্যে সরকার রফতানি বৃদ্ধি এবং আমদানি কমানোর নীতি নিয়েছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সহযোগিতায়।
অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আরও প্রসারিত হয়েছে– তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বৈশ্বিক সংকট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতায় দেশটিকে অবশ্যই রফতানি-আমদানি অনুপাতের উন্নতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সমান অগ্রাধিকার দিতে হবে।
যদিও ন্যূনতম তিন মাসের চেয়ে বেশি দিন আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক রিজার্ভ রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা আরও দুর্বল হলে রিজার্ভের অবক্ষয় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুদ্ধারে একটি ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাজেট ব্যবস্থাপনার সব স্তরে কৌশলগত হস্তক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন। মন্ত্রী ও বিভাগগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছেন কীভাবে বিদেশ গমনের ব্যয় ছাড়াই উন্নয়ন প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। দেশবাসীকে জ্বালানি ও বিদ্যূৎ সাশ্রয়ের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে দেশে কোন প্রকার সংকট দেখা না দেয়।
অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে তিনি শুধু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন এবং কম গুরত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো স্থগিতের ওপর গুরুত্বারোপ করতে জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থাগুলোও বারবার বলে আসছে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করার যৌক্তিক কোনও কারণ নেই।
প্রথমত, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি প্রধানভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। মহামারির কারণে এই খাতে ধস নামে। এর ফলে দেশটির রিজার্ভ কমতে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানিকৃত জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ একেবারেই কমে যায়। গুরুত্বপূর্ণ আমদানি প্রায় একসঙ্গে স্থগিত করা হয়। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম দেয় এবং ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয় ও পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে।
বিপরীতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হলো গার্মেন্টস এবং বিদেশ থেকে পাঠানো বাংলাদেশি কর্মীদের রেমিট্যান্স। দক্ষিণ এশিয়ার অপর দেশগুলোর তুলনায় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বেশি শক্তিশালী।
মহামারির শুরুর দিকে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে অনেক প্রবাসী কাজ হারানোর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমবে। যদিও সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সফলতায় অনেক বাংলাদেশি বিদেশে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরেছেন এবং প্রাক-মহামারি সময়ের হারে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কায় জনগণের ব্যাপক ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ ছিল ক্ষমতাসীন রাজাপাকসের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের ব্যাপক দুর্নীতি। বাংলাদেশেও দুর্নীতি একটি ইস্যু হলেও এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি। এর ফলে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার একেবারে কোনও সম্ভাবনাই নেই।
মহামারি পরবর্তী সময়ে দেশটির গতি দেখলে জানা যায়, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কিছু আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
তবুও স্বল্পমেয়াদি কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে, মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে, মহামারির দুই বছরে মন্থর গতির কারণে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের কমে নেমে এসেছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং জ্বালানির মূল্য সহনশীল রাখতে সরকার চাপে রয়েছে। কিন্তু সাময়িক সংকট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ কার্যকর হওয়া উচিত।
সংকট মোকাবিলায় সরকার সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে। বাস্তবে এছাড়া কোনও উপায় নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যতদিন থাকবে, ততদিন মিতব্যয়ী হতে হবে।
অর্থনীতির নিরিখে সাধারণ ধারণা হলো, কোনও দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা-যোগ্য এবং অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ঝুঁকি কম। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪৪ শতাংশ। যদিও বৈদেশিক ঋণ ২১.৮ শতাংশ বৃদ্ধি, বৈশ্বিক নিম্নমুখিতায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি এবং রিজার্ভ কমে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির ৫০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও ভারত রয়েছে।
রিজার্ভের কথা বলতে গেলে ৪০ বিলিয়ন ডলার কম মনে হলেও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়ের তুলনায় তা এখন দ্বিগুণ। ওই সময় তিন মাস আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ ছিল। অথচ এখন রয়েছে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ।
সংকটকালে আমরা নিজেরা যেমন পরিবারের ব্যয় কমাই, দেশকেও ব্যয় কমাতে হয়। শ্রীলঙ্কা নিজের সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। ভুল নীতির কারণে শস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এ ধরনের এমন কোনও সংকট নেই বাংলাদেশে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.