ফ্লোর প্রাইজ তুলে নেয়ার আবেদন করা হয়নি
গুজবে শেয়ারবাজারে ব্যাপক দর পতন
শাহ আলম নূর : ফ্লোর প্রাইজ তুলে নেয়া হচ্ছে এমন গুজবের প্রভাবে দেশের শেয়ারবাজারে ব্যাপক দর পতন হয়েছে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন ফ্লোর প্রাইজ তুলে নেয়া হবে এমন কোন আবেদন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কাছে করা হয়নি। একটি গোষ্ঠি বাজারকে অস্থির করতে এমন গুজব ছড়িয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাজার পতনের সাথে ফ্লোর প্রাইজের কোন সম্পর্ক নেই। কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারির সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের পক্ষ থেকে এমন কোন আবেদন করা হয়নি। বরং দেশের শেয়ারবাজার স্থিতিশিল হোক এমনটিই তারা চান।
তবে কোন কারন ছ্ড়াাই পুরোটাই গুজবের কারনে বুধবার (১০ আগস্ট) দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক কমেছে ৭৮ পয়েন্ট। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক কমেছে ২০৬ পয়েন্ট। এর ফলে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ উত্থানের পর দ্বিতীয় সপ্তাহের তিন কর্মদিবসের মধ্যে তিনদিনই পুঁজিবাজারে দরপতন হলো। তার আগের টানা দুই মাস পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন জ্বালানি দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাজারে ক্রেতার সংকট তৈরি হয়েছে। এতে শেয়ার কেনার চেয়ে বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ বেড়েছে। শেয়ার বিক্রির চাপে বড় দরপতন হয়েছে। এদিন লেনদেন হওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম, সূচক ও লেনদেন কমেছে।
তারা বলছেন বিশ্ব অর্থনীতির উদ্বেগের মধ্যে সরকার দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে। এই ইস্যুতে শেয়ারবাজারে নতুন উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন ইস্যুও যোগ হয়েছে। এই দুই ইস্যুতে শেয়ারবাজারে দরপতন আরও ভারি হয়েছে।
এক যুগ যাবত শেয়ারবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনার দাবি চলছিল। শেয়ারবাজারের সব পক্ষই বলছিল, এই দাবি পূরণ হলেই শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। স্থিতিশীলতার পথে শেয়ারবাজার অগ্রসর হবে। কিন্তু দাবি পূরণের ঘোষণা আসার পরেও শেয়ারবাজার হাঁটছে উল্টো পথেই।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে গণনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আসার পর টানা তিন কর্মদিবস যাবাত দরপতন চলছে শেয়ারবাজারে। এর মধ্যে রোববার ৮ পয়েন্ট, সোমবার ৪৫ পতনের পর মঙ্গলবার আশুরার ছুটি শেষে আজ বুধবার আরও ৭৮ পয়েন্ট পড়ল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স। অর্থাৎ তিন কার্যদিবসে ১৩১ পয়েন্ট হারাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক।
অথচ প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এক্সপোজার লিমিট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর আগের সপ্তাহে টানা পাঁচ কার্যদিবসে সূচক বেড়েছিল ৩৩১ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে লেনদেনেও মিলেছিল ঊর্ধ্বগতি।
এরপর গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনার ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই বাজারমূল্য ধরা হবে।
এতদিন বাজারমূল্য অথবা ক্রয়মূল্যের মধ্যে যেটি বেশি, সেটিকে ধরেই ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা করা হতো। এর ফলে কোনো শেয়ারের দর বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতো। এটিকে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা হিসেবে ধরা হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর আশা করা হচ্ছিল, এবার বাজারে বিক্রয়চাপ কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু সার্কুলার জারি হলেও বাজারে এর কোন প্রভাবই দেখা গেল না। বরং বাজার উল্টোপথেই দৌড় দিচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেল এবং ডলারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি-এই দুই ইস্যুর আগুনে এক যুগের দাবি পূরণ ছাই হয়ে গেল।
এদিকে, কিছুদিন যাবত শেয়ারবাজারের কতিপয় ভুইফোঁড় সংগঠন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে খবরের বড় শিরোনাম হচ্ছেন। তারা বিএসইসিকে বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর এবং নতুন বিনিয়োগ আনার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোন নমুনা দেখা যাচ্ছে না।
বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, ওইসব সংগঠনের নেতারা কথায় একশত ভাগ স্বচ্ছ, কিন্তু কাজে-কর্মে একশত ভাগ পিছলা। তারা কেবল বিএসইসির কর্মকর্তাদের ধোঁকাই দিচ্ছেন, আসলে কাজের কাজ কিছুই করছেন না। বিএসইসির উচিত, তাদের কাজ-কর্ম ও নিজস্ব বিনিয়োগ শক্তভাবে খতিয়ে দেখা। তাহলেই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে, ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমায় নতুন সার্কুলার হলেও ব্যাংকগুলো এখনো বাজারমুখী হয়নি। শেয়ারবাজারের প্রতি ব্যাংকগুলোর নেতিবাচক মনোভাব এখনো রয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোকে কিছুটা বাজারমুখী করা গেলেই বাজারের সার্বিক চেহারা বদলে যাবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বুধবার লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪৩টি ছিল ক্রেতাশূন্য। পাশাপাশি লেনদেন হওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় অর্ধশতাধিক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে গেছে। আর তাতে এসব কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচাও কমেছে। সূচক পতনের পাশাপাশি লেনদেন হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ৭০০ কোটি টাকার গড়ে নেমে এসেছে।
এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকেছে গেছে। পাশাপাশি ডলারের বাজার প্রতিনিয়তই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এ কারণে ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তাতে পুঁজিবাজার বড় দরপতন হয়েছে।
ডিএসইর তথ্য মতে, বুধবার ডিএসইতে ২৩ কোটি ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৭টি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। যার মূল্য ৭৯৯ কোটি ৪৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৮৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগের দিনের চেয়ে লেনদেন পৌনে তিনশ কোটি টাকা কমেছে।
এদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৭৯টি কোম্পানির শেয়ারের। এর মধ্যে ২৬টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ২৭৯টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৭৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৮ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৮০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইএস সূচক ১৩ দশমিক ৮১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৫৪ পয়েন্টে এবং ডিএস-৩০ সূচক ২৬ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ২১০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এদিন লেনদেনে শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার। এরপর রয়েছে সোনালী পেপার, সি পার্ল বিচ, মালেক স্পিনিং, ইন্ট্রাকো , কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, অলিম্পিক, লাফার্জহোলসিম, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড।
দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২০৫ পয়েন্ট কমে ১৮ হাজার ২৩২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ বাজারে ২৬৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ১৮৯টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৩টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
এদিন সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১৭ কোটি ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ১৩১ টাকার শেয়ার। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৮ কোটি ৩৭ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ টাকার শেয়ার।