আজ: রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ইং, ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৮ অগাস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

১২ ব্যাংকের ডলার কারসাজি, ছয় এমডিকে শোকজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাজারে মার্কিন ডলারের সংকট। এটিকে পুঁজি করে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক। অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুত করে হাতিয়ে নিয়েছে বড় অংকের মুনাফা। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। এসব অভিযোগে ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর এবার এসব ব্যাংকের এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার ব্যাংকগুলোর এমডিদের এই চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া অতিরিক্ত মুনাফা করা আরও ৬ ব্যাংককে পর্যায়ক্রমে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব ব্যাংকের এমডিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

এর আগে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভা‌গের প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ডলারে অতিরিক্ত মুনাফার বিষয়ে ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আপাতত এ ছয় ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংকগুলোকেও চিঠি দেওয়া হবে। এছাড়া প্রতিটি ব্যাংকে ইন্সপেকশন করা হবে। কারণ একই কাজ আরও অনেক ব্যাংক করেছে। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ডলার নিয়ে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে এমন ১২টি ব্যাংকের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে- ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক।

জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন থেকে সর্বোচ্চ ৭৭০ শতাংশ মুনাফা করেছে বেসরকারি ব্যাংক ‘ব্যাংক এশিয়া’। যেখানে ২০২১ সালের একই সময়ে ডলার কেনাবেচায় মুনাফা করেছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। সেখানে তারা এ বছরের প্রথম ছয় মাসে লাভ করেছে ২০০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি।

ব্যাংক এশিয়া ছাড়াও ৯টি ব্যাংক এই সময়ের মধ্যে ২০০ শতাংশের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে। আর দুটি ব্যাংক ১৪০ শতাংশের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে বলে জানা গেছে।

ডলার লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছে তার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রাইম ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ৫০৪ শতাংশ বা ১২৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। একই সময়ে, এনসিসি ব্যাংক ৫০০ শতাংশ বা ১০০ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ৪১৭ শতাংশ বা ৭৫ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৪০৩ শতাংশ বা ১১৭ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৩৫৩ শতাংশ বা ১০৬ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক ৩৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৪৫ শতাংশ বা ১২০ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২৩৪ শতাংশ বা ৯৭ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ বা ১৩৫ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৫৯ শতাংশ বা ৪৩ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক ১৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে।

এদিকে দেশে ডলারের সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানিতে দেওয়া হয়েছে নানা শর্ত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দেওয়া হয়েছে নীতিগত ছাড়। এছাড়া ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে নিয়মিত। ডলার কারসাজির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে চালানো হচ্ছে অভিযা। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুধবার মানি চেঞ্জারগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফার সীমা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা বৈঠক করে। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ডলার কেনাবেচায় কত টাকা মুনাফা করবে তা তারা নিজেরাই ঠিক করবে, তবে বেচাকেনার মধ্যে পার্থক্য যেন এক টাকার বেশি না হয়। এসব পদক্ষেপের কারণে ডলারের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। তবে ৪ জুলাই এ ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ। আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদে দিতে হবে।

এর আগে, গত ১০ মের নির্দেশনায় কিছু পণ্যে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার ৫০ ও ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেওয়া ঋণ কেবল রপ্তানি আয় বা জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেওয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এসব পদক্ষেপের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। কমেছে আমদানি এলসি কমার হারও। আমদানির লাগাম টানতে যেসব শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; তার সুফল আসতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা জুলাই মাসের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। জুলাই মাসে আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।

এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এ দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা।

তবে বা‌ণি‌জ্যিক ব্যাংকগু‌লো‌তে এখন ১০৬ থে‌কে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বি‌ক্রি হচ্ছে। আর খোলা বাজারে ডলারের দাম ১১০ টাকা পর্যন্ত। ‌এর আগে খোলা বাজারে ডলারের দাম প্রথমবারের মতো ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। এরপর আবার কমে আসে। প‌রে গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। গত ১০ ও ১১ আগস্ট নগদ ডলার ১২০ টাকায় উ‌ঠে‌ছিল।

এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বা‌ড়ি‌য়ে‌ বি‌ক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দে‌শি-বিদে‌শি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ কর‌তে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সি‌টি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খা‌তের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

এছাড়া ডলারের কারসা‌জি রো‌ধে খোলা বাজার ও এক্স‌চেঞ্জ হাউজগু‌লো‌তে ধারাবা‌হিক অভিযান পরিচালনা ক‌রছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। কারসা‌জির অপরা‌ধে কিছু মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করা সহ বেশকিছু প্র‌তিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নি‌তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হ‌য়েছে।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিগত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছর আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।

১৬ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৫৪ কোটি (৩৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) ডলারে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুত থাকা এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

২ উত্তর “১২ ব্যাংকের ডলার কারসাজি, ছয় এমডিকে শোকজ”

  • Azizul Islam Ansari says:

    নিতি নির্ধারণের অভাবে এই সুযোগ নিয়েছে। এটা সরকারের দুর্বলতাত প্রমাণ করে। এখন চাপ দিয়ে কি হবে? এখনো বাজারে ডলারের মূল‍্য স্থির নাই। সোনালী ব‍্যাঙ্ক ও জনতা ব‍্যাঙ্কের ওয়েজআরনার শাখার কর্তব্য কর্মকর্তারাও ডলারের দাম বৃদ্ধির সাথে জড়িত। তাদের সম্পদের হিসাব নিন।এবং কিছু ক্ষমতাই থাকা সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের সম্পদের হিসাব নিন দেখবেন তারা কি পরিমাণ ডলার মজুদ করেছে?

  • Azizul Islam Ansari says:

    নিতি নির্ধারণের অভাবে এই সুযোগ নিয়েছে। এটা সরকারের দুর্বলতা প্রমাণ করে। এখন চাপ দিয়ে কি হবে? এখনো বাজারে ডলারের মূল‍্য স্থির নাই। সোনালী ব‍্যাঙ্ক ও জনতা ব‍্যাঙ্কের ওয়েজআরনার শাখার কর্তব্য কর্মকর্তারাও ডলারের দাম বৃদ্ধির সাথে জড়িত। তাদের সম্পদের হিসাব নিন।এবং কিছু ক্ষমতাই থাকা সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের সম্পদের হিসাব নিন দেখবেন তারা কি পরিমাণ ডলার মজুদ করেছে?

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.