এমারেল্ড অয়েল
গ্যাস সংকটে স্পন্দন’র পরিশোধিত তেল উৎপাদন বন্ধ
শাহ আলম নূর
দীর্ঘ ছয় বছর বন্ধ থাকার পর আবার উৎপাদনে ফিরেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল লিমিটেড। তবে গ্যাস সংকটে স্পন্দন’র পরিশোধিত তেল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সারা দেশে স্পন্দন’র তেলের চাহিদা থাকলেও পরিশোধিত তেলের উৎপাদন বন্ধ থাকায় সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কোম্পানিটি।
মিনোরি বাংলাদেশ নামের জাপানি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে প্রাণে স্পন্দন ফিরেছে কোম্পানিটির। ইতোমধ্যে দেশের বাজারে কোম্পানির উৎপাদিত রাইস ব্রান অয়েলের আনুষ্ঠানিক বাজারজাত শুরু হয়েচে। এমারেল্ড অয়েলের এই পুনরুজ্জীবন ও সম্ভাবনা নিয়ে শেয়ারবাজার নিউজের সাথে কথা বলেছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আফজাল হোসেন।
তিনি বলেন এমারেল্ড অয়েল লিমিটেড একটি সম্ভাবনাময় কোম্পানি ছিল। এই কোম্পানির উৎপাদিত রাইস ব্রান অয়েল ‘স্পন্দন’ ছিল বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু উদ্যোক্তাদের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ২০১৬ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন মালিকরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। কোম্পানিটি ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি বন্ধ ছিলো।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এমারেল্ড অয়েলকে পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলে সকল নিয়ম মেনে মিনোরি বাংলাদেশ কোম্পানিটির দায়িত্ব গ্রহণ করে। এবং নিয়মিত উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ থাকায় এমারেল্ড অয়েলের কারখানার বেশিরভাগ যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। কারখানার স্ট্রাকচার স্টিলের তৈরি। এই স্ট্রাকচারও মরিচা পড়ে অনেকাংশে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফ্যাক্টরির সীমানাপ্রাচীর না থাকায় অনেক যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়।
তিনি বলেন আমরা ৭ জন ভারতীয় টেকনিশিয়ানসহ বাংলাদেশের কিছু দক্ষ জনবল নিয়ে কারখানাটিকে মেরামত করে উৎপাদন উপযোগি করে তৈরী করেছি। সব যন্ত্রাংশ নতুন করে সেটাপ করেছি। সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে সমস্যা শুধু মেশিনারিজ নষ্ট হওয়ার মধ্যেই সীমিত ছিল না। আমাদেরকে আরও কিছু বড় সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়েছে। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিতাস গ্যাসের বকেয়া বিল ছিল ৩২ লাখ টাকার। ২০২১ সালের জুন মাসে আমরা তিতাস গ্যাসের কাছে বিলের প্রতিবেদন চাইলে তারা ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বকেয়ার একটি স্টেটমেন্ট দেয়। অর্থাৎ কোম্পানিটি বন্ধ থাকলেও এখানে একটি লাইনচার্জ যুক্ত হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে আমরা তিতাস গ্যাসের এই বকেয়া বিল পরিশোধ করি। কিন্তু এরপর তিতাস কর্তৃপক্ষ ওই বকেয়ার উপর ৯৯ লাখ টাকার সুদ দাবি করে। এই টাকাটাও আমরা পরিশোধ করেছি। কিন্তু আমরা এর পরেও ২৪ ঘন্টা গ্যাস পাই না। গ্যাস পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ১২ ঘন্টা। এ কারণে এখনো আমাদের তেল শোধনাগার বা রিফাইনারি চালু করা যায়নি। কারণ রিফাইনারী চালু করতে হলে একটানা ৫ দিনের গ্যাসের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
রিফাইনারি চালু করতে না পারায় আমরা ক্রুড অয়েল তেল বিক্রি করছি। ট্রেডারের মাধ্যমে এই তেল ভারতে পাঠানো হয়েছে। এমারেল্ড অয়েলের এখনো সরাসরি আমদানি-রপ্তানির অনুমোদন পারমিশনের চেষ্ঠা চলছে। অনুমোদন পেলে আমরা সরাসরি তেল রপ্তানি করতে পারবো।
তিতাসের কাছ থেকে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ পাওয়ায় রিফাইনারি চালুর জন্য আমাদেরকে এলপিজি স্টেশন নির্মাণ করতে হয়েছে। এরপর থেকে যে সময়টুকুতে গ্যাস থাকে না, সেই সময়টুকু এলপিজি দিয়ে আমরা তেল রিফাইনের কাজ করি। কিন্তু এলপিজির খরচ তিতাসের গ্যাসের তুলনায় প্রায় ৬ গুণ বেশি।
সকল প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আমরা তেল রিফাইনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। রিফাইন করা তেল ‘স্পন্দন’ ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত শুরু করলেও তা এখন বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের সংকটে রিফাইন তেল তৈরী সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন এমারেল্ড অয়েলে দুটি ইউনিট আছে। এর একটির ধানের কুঁড়া ক্র্যাশ করার ক্ষমতা ১৮০ টন,অপরটির ক্ষমতা ১৫০ টন। ইউনিট দুটির দৈনিক মোট উৎপাদনক্ষমতা ৩৩০ টন। তবে বর্তমানে শুধু ১৮০ টনের ইউনিটটি সচল আছে। এই ইউনিটে ধানের কুঁড়া ক্র্যাশ করে ৩৫ টনের মতো অপরিশোধিত তেল বা ক্রুড অয়েল পাওয়া যায়। এ থেকে দৈনিক পরিশোধিত তেল পাওয়া যায় প্রায় ২৫ টন। তাই গ্যাসের সংকট কেটে গেলে আমরা প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার লিটার তেল বাজারে দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
অচল ইউনিটটি সচল করা গেলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে। তবে চালু করতে হলে এই ইউনিটের মেশিনারিজ সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংস্থাপন করতে হবে।
তিনি বলেন চালের কুড়া থেকে তেল সংগ্রহ করার পর কুঁড়ার যে অংশ অবশিষ্ট থাকে, তাকেই ডি-অয়েলড রাইস ব্রান বলে। এই ডি-অয়েলড রাইস ব্রান পোল্ট্রি খাতে মাছ এবং মুরগীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাজারে এর বেশ ভাল চাহিদা রয়েছে।
তিনি বলেন এমারেল্ড অয়েল বন্ধ হবার আগে এই কোম্পানির উৎপাদিত ‘স্পন্দন’ ব্র্যান্ডের রাইস ব্রান অয়েল বাজারে ছিলো। তখন বাংলাদেশী বংশদ্ভুত একজন জাপানি ব্যবসায়ী মিয়া মামুন বাংলাদেশ থেকে স্পন্দনের তেলের স্যাম্পল জাপানে নিয়ে যান। উদ্দেশ্য ছিল এই তেল জাপানে রপ্তানি করা।
জাপানে এক কোয়ালিটি টেস্টে তেলটি জাপানের বাজারে রপ্তানিযোগ্য বলে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসার আগেই এমারেল্ড অয়েল বন্ধ হয়ে যায়। জাপানের বাজারের এই তেল রপ্তানিযোগ্য হওয়ায় কোম্পানিটির প্রতি তার অনেক আগ্রহ ছিল। তিনি ভেবেছেন, এমারেল্ড অয়েল টেকওভার করেন তাহলে হয়তো স্পন্দন রাইস ব্রান অয়েল তিনি জাপানে রপ্তানি করতে পারবেন। আর দেশের বাজারে বিপণনের সুযোগ তো আছেই। তাই এবার সুযোগ পাওয়ায় তিনি কোম্পানিটি টেকওভার করেন।
দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে রাইস ব্রান অয়েলের অংশ ১০ শতাংশের মতো। অর্থাৎ ভোজ্য তেলের ১০ শতাংশের যোগান রাইস ব্রান অয়েল থেকে দেয়া সম্ভব। এই বাজার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। দেশে রাইস ব্রান অয়েলের যে কয়টি কারখানা আছে, সব ক’টি যদি রিফাইন করে তেল বিক্রি করতে চায়, তাহলে দৈনিক প্রায় ৮০০ টন বাজারে ছাড়া সম্ভব। কিন্তু বেশিরভাগ কোম্পানিরই রিফাইনারি ইউনিট নেই।
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশে তেলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীন উৎপাদন বাড়াতে হবে। রাইস ব্রান অয়েল এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কাঁচামাল তথা কুঁড়ার অভাবে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দেশের ভেতরেই যখন কাঁচামালের সঙ্কট, তখন এই কুঁড়া ভারতে রপ্তানির কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা এখান থেকে কুঁড়া নিয়ে তেল উৎপাদন করছে, আর এখানে কুঁড়ার অভাবে তেলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কুঁড়ার রপ্তানি বন্ধ করা গেলে দেশে রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন বাড়বে। তাতে সোয়াবিনসহ আমদানিকৃত তেলের উপর নির্ভরতা কমবে। তেলের বাজার হবে স্থিতিশীল। বাঁচবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। তাই সরকারের উচিৎ, রাইস ব্রান তেলের কাঁচামাল ও ক্রুড অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া।
রাইস ব্রান তেল স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। এতে কোলেস্টেরল নেই। হৃদরোগ আর হার্ট ব্লক হবার ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দিতে পারে এই তেলের ব্যবহার। এই তেল সয়াবিনের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ সাশ্রয়ী। অর্থাৎ সোয়াবিনের তুলনায় এই তেল ২০ শতাংশ কম লাগে। এছাড়া রাইস ব্রান তেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও বেশ কার্যকরী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বলতে মিনোরি বাংলাদেশের একটা প্রকল্পনা রয়েছে। আমরা দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই। কৃষিজাত পণ্যের মান উন্নয়ন করতে চাই। কৃষকরা যাতে পণ্যের ভাল মূল্য পায়; তারা যাতে অর্গানিক, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদন করতে পারে, তা নিয়েও কাজ করতে চায় মিনোরি বাংলাদেশ। পাশাপাশি চাষাবাদের উপযোগী ভালো বীজ, ভালো মেশিনারিজ, ভালো যানবাহন দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। আর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়টি হলো আমাদের খাবারের বা কৃষি পণ্যের বড় একটা অবশিষ্ট থাকে, মিনোরি বাংলাদেশ এই অবশিষ্ট অংশকেও কাজে লাগাতে চায়।
আমরা স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাইস ব্রান তেলসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চান বলে তিনি জানান ।