নিবন্ধন জটিলতা এড়াতে কোম্পানি অধিগ্রহণ বাড়ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক : সময় ও ব্যয় বাঁচাতে উদ্যোক্তারা এখন নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে বিদ্যমান রুগ্ন বা ব্যর্থ কোম্পানিগুলো কিনে নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।
সম্প্রতি তৈরি পোশাক (আরএমজি), টেক্সটাইল, চামড়া এবং প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াকরণ খাতে এমন অনেকগুলো অধিগ্রহণ দেখা গেছে।
গত বছরই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল কিনে নিয়েছে আলিফ গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ ছিল। মালিকানা বদলের পর মেরামত ও নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর প্রায় এক বছরের কম সময়ে উৎপাদনে ফিরেছে কারখানাটি।
আরেক তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেডের নতুন বিনিয়োগ পেয়ে চার বছর পর রাইস ব্র্যান ভোজ্য তেল উৎপাদনে ফিরেছে কোম্পানিটি।
গত তিন বছরে এরকম প্রায় ৮ হাজার কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্যানুসারে, আগের বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানি অধিগ্রহণ বেড়েছে ১২ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের কোম্পানি অধিগ্রহণ বাড়ানোর অন্যতম কারণ হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়ানো। তাছাড়া কোম্পানি অধিগ্রহণ করলে দ্রুত ব্যবসা শুরু করতে পারছেন বলে এ ধরনের অধিগ্রহণ বাড়ছে বলে জানান তারা।
উদ্যোক্তারা জানান, একটি কোম্পানি খুলে নতুন ব্যবসা শুরু করতে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নেওয়ার জন্য তাদের নানা ভোগান্তি পোহানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যয়ও করতে হয়।
উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি নতুন কোম্পানি গঠনের আগে তাদের গাদা গাদা অনুমোদন নিতে হয়। সেসবের মধ্যে রয়েছে—আরজেএসসি থেকে ব্যবসার অনুমোদন ও নেম ক্লিয়ারেন্স, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র, এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার ও ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন। এ কারণে বড় কোম্পানিগুলো বন্ধ থাকা, আর্থিকভাবে রুগ্ণ বা চলমান কোম্পানিগুলোকে কিনে নিচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘এই অধিগ্রহণ প্রবণতা মূলত আরএমজি, টেক্সটাইল, চামড়া এবং প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াকরণ খাতে বেশি দেখা যাচ্ছে।’
সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলকে অধিগ্রহণ করা আলিফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিমুল ইসলাম বলেন, ‘কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে খুব কম সময়ে ব্যবসা শুরু করতে পেরেছি। কিন্তু নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে গেলে কমপক্ষে তিন বছর সময় প্রয়োজন হতো।’
বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিটিতে নতুন যন্ত্রপাতি বসিয়ে ও কারখানা মেরামত করেই উৎপাদনে আসা সম্ভব হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
আজিমুল ইসলাম বলেন, নতুন কোম্পানি খুলে বা কারখানা নির্মাণ করে এত দ্রুত উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হতো না। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হতো। এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হতো অনেক বেশি।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) ‘রিমুভিং টাইম, কস্ট অ্যান্ড প্রসেস রিলেটেড বটলনেকস ইন কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিভিন্ন জটিলতার কারণে সময়সাপেক্ষ কোম্পানি নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তারা তৃতীয় পক্ষের সেবা নিতে বাধ্য হন। যার কারণে নতুন ব্যবসা শুরু করতে তাদের ব্যয় বাড়ে ৪৩ শতাংশ।
গবেষণাটিতে আরও উঠে এসেছে, আরজেএসসি নিবন্ধনে ৮৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন পড়ে; এতে ব্যয় ৪৯.২২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তিতে ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে, যাতে ব্যয় বাড়ে ৩২ শতাংশ।
বাড়তি অফলাইন মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে বলে নিবন্ধন-পূর্ববর্তী প্রক্রিয়ার চাইতে নিবন্ধন-পরবর্তী প্রক্রিয়া বেশি কঠিন।
রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘আরজেএসসি, সিটি কর্পোরেশন ও এনবিআরের মতো কয়েকটি সংস্থা সম্পৃক্ত থাকায় প্রচলিত ব্যবসার লাইসেন্সিং ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া বেশ জটিল। আর ব্যবসা ও বিনিয়োগের ধরনের ভিত্তিতে সংস্থার সংখ্যাও কমবেশি হয়।’
ব্যবসার নিবন্ধন এবং ব্যবসার একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের লাইসেন্স নবায়নকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসা শুরু করার সমস্ত ঝামেলা এড়াতে দ্রুত ও নিবিড় মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজন একটি ন্যাশনাল ওএসএস পরিষেবা প্ল্যাটফর্ম, যা শিল্প ও সেবা খাতের সব ধরনের বিনিয়োগ ও ব্যবসাকে সংযুক্ত করবে এমন।
বিল্ডের গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য একটি সম্পূর্ণ অটোমেটেড রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন।
সব পর্যায়ের কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস, পেমেন্টের জন্য মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অন্তর্ভুক্তকরণ, মোবাইলবান্ধব ওয়েবসাইট নিশ্চিতকরণ, অনলাইন আবেদন সংশোধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক্সপ্রেস সার্ভিস চালুর পরামর্শও দেওয়া হয় বিল্ডের গবেষণায়।
কর্পোরেট আইন বিশেষজ্ঞ তানজিব-উল আলম বলেন, কোম্পানি নিবন্ধন একটি জটিল বিষয়। কোনো বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কোনো কোম্পানির অংশীদার হতে চাইলে তাদের আরজেএসসিতে গিয়ে স্বাক্ষর করতে হয়, যা অন্যান্য দেশে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়।
তিনি বলেন, ‘কোম্পানি নিবন্ধনে এখন আবেদন করতে হয় অনলাইনে। নথিপত্র অনলাইনে দাখিল করা যায়। কিন্তু নিবন্ধনসহ আনুষঙ্গিক ফির রসিদ সরাসরি আরজেএসসি কার্যালয়ে গিয়ে জমা দিতে হয়। তাহলে অটোমেশন কী করে হলো?’
তানজিব-উল আলম আরও বলেন, ‘কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের জন্য আরজেএসসি কার্যালয়ে যাওয়ার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না। যার শেয়ার, তিনি হস্তান্তর করছেন কি না, তা যাচাই-বাছাই করার জন্য এখন অনলাইনে নানা ব্যবস্থা আছে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে। তাহলে বাংলাদেশে কেন নয়?’
ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘বিজনেস ইনকর্পোরেশন’ প্রক্রিয়া সম্প্রতি কিছু সংস্কারের মাধ্যমে উন্নত করা হয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটিকে সংক্ষিপ্তকরণ, ডকুমেন্টেশন ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর জন্য এখনও ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন।
আরজেএসসির রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত সচিব) শেখ শোয়েবুল আলম এনডিসি বলেন, ‘কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য যেসব জটিলতার কথা বলা হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হলো বেশিরভাগ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিবন্ধনের কাজ করে থাকে।’
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, কোম্পানি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করা হয়েছে। তবে আরও সংস্কার করতে হবে। কোম্পানি নিবন্ধনের সময় কমিয়ে আনতে কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।