পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশনসহ ১২ দফা আবেদন
শাহ আলম নূর : পুঁজিবাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করনীয় নির্ধারনে ১২ (বার) দফা দাবি পেশ করেছে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশন।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশন’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ২০১০-১১ অর্থবছরে শেয়ারবাজারে মহাধ্বসের পর বিনিয়োগকারীরা এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যে, অনেকে পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অনেকে মানসিক যন্ত্রণায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিনিয়োগকারীরা পুঁজি ফেরত পেতে নতুন বিনিয়োগ করলেও বারংবার অদৃশ্য চক্রের কাছে পরাজিত হয়েছে- যা বর্তমানেও চলমান।
গত ২০২০ ইং সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পুন:গঠনপূর্ব্বক আপনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি অনেক আস্থা ফিরে পায়। কিন্তু সেই আস্থায় পুনরায় ভাটা পড়তে শুরু করেছে। কারণ, প্রাইমারি মার্কেট ও এসএমই মার্কেট চাঙ্গা করতে ফিক্সড প্রাইস এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কমিশন যেসব কোম্পানির আইপিও এবং কিউআইও অনুমোদন দিচ্ছে- সেগুলো পুঁজিবাজারে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। একদিকে প্লেসমেন্ট কারসাজি, অন্যদিকে ইলিজিবল ইনভেস্টরদের সাজানো নাটকে বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব সেকেন্ডারি মার্কেটে পড়ছে। এছাড়া বিএসইসির পাবলিক ইস্যু রুলস ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ না দেখে একটি বিশেষ শ্রেণীকে সুযোগ-সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ইলিজিবল ইনভেস্টরদের বিডিং কারসাজির কারণে অতি উচ্চ মূল্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে শেয়ার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য বর্তমান পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বিনিয়োগকারীদের ১২ (বার) দফা দাবিসমূহ নিম্নরূপ।
০১. পুঁজিবাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে তারল্য প্রবাহ দ্রুত বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও বিডিবিএল ব্যাংক লিমিটেডের মার্চেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে হবে।
০২. ফ্লোর প্রাইস অব্যাহত থাকায় বিনিয়োগকারীদের নীরব রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। এভাবে ফ্লোর প্রাইসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলে লেনদেনে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হবে। যেমন- তালিকাভুক্ত প্রায় ৩৯৬টি কোম্পানির মধ্যে প্রায় ২৮৫টি কোম্পানি ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করছে। এটি একটি অসুস্থ মার্কেটের লক্ষণ। একদিকে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বৃদ্ধি পাচ্ছেনা, অপরদিকে, মার্জিন ঋণের কারণে ইন্টারেস্ট ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। এতে কিছুদিন পর বিনিয়োগকারীদের পোর্টফ্লোলিও শুন্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরূপ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগকারীরা এক সময় বাজার বিমুখ হবে এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আস্তে আস্তে চলে যেতে বাধ্য হবে। যদিও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষার্থেই ফ্লোর প্রাইস আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। কাজেই বিনিয়োগকারীদের পুঁজির সুরক্ষার লক্ষ্যে এবং পুঁজিবাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য মার্জিন ঋণের ইন্টারেস্ট বন্ধ করণ ও ফ্লোর প্রাইস বিষয়ে বিএসইসিকে অতি দ্রুত গঠন মূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
০৩. পুঁজিবাজারে বড় অংকের অর্থ উত্তোলনকারী আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোকে দ্রুত স্থগিত করতে হবে। কেননা, বাজারে বর্তমানে তারল্যের ব্যাপক সঙ্কট চলছে।
০৪. পুঁজিবাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত স্মল ক্যাপ মার্কেট, সরকারী ট্রেজারি বন্ড ও সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় বিল মার্কেট, এটিবি মার্কেট ও কমোডিটি এক্সচেঞ্জ মার্কেটকে আপাতত: স্থগিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনে পৃথক সফ্টওয়্যার স্থাপন করতে হবে।
০৫. ব্যাংক ও আর্থিক খাতে লভ্যাংশ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অযাচিত হস্তক্ষেপ দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
০৬. বিএসইসির ২ সিসি ধারা অনুযায়ী কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের এককভাবে ২% ও সম্মিলিতভাবে ৩০% শেয়ার ধারণ দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আইপিও কোটায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৮০% এ উন্নীত করতে হবে। এছাড়া, ওটিসি মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের বিশাল অংকের টাকা আটকে আছে। এ মার্কেটের যেসব কোম্পানি উৎপাদনে রয়েছে, নিয়মিত এজিএম করছে এবং বিএসইসির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে- সেগুলোকে দ্রুত মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
০৭. পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভাল ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি আনতে হবে। কোনক্রমেই দূর্বল ও ঋণগ্রস্ত কোম্পানির অনুমোদন দেয়া যাবেনা। এছাড়া, এসএমই খাতের দূর্বল ও জালিয়াতী কোম্পানিগুলোকে দ্রুত বন্ধ করতে হবে, লেনদেনে ম্যানিপুলেশনকারীদেরকে শনাক্ত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানি সমূহের সন্তোষজনকহারে লভ্যাংশ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
০৮. বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহকে নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী দ্রুত বিনিয়োগে বাধ্যকরণ: তথা বিনিয়োগসীমা ২০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটিতে উন্নীত করতে হবে।
০৯. বিএসইসিকে ট্রেকহোল্ডারদের নিয়ে মিটিংয়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, বিএপিএলসি, আইসিবি, রাষ্ট্রয়াত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিনিয়োগকারী সংগঠন, বিএবি, এবিবি, ডিবিএ, বিআইএ, লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স এসোসিয়েশন ও সাংবাদিক সংগঠনদের নিয়ে পর্যালোচনামূলক সমন্বয় মিটিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
১০. আইন করে ফোর্স সেল দ্রুত বন্ধ করতে হবে। বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার সময় বিএসইসির মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ বন্ধ করতে হবে এবং বাজারে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মার্জিন ঋণধারী অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এগুলোকে দ্রুত লেনদেনের লক্ষ্যে বিধি-নিষেধ শিথিল করতে হবে। এছাড়া, ফাস্টলিড সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের গ্রেফতারের ব্যবস্থাপূর্ব্বক ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আত্মসাতের ১০ কোটি টাকা দ্রুত ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. নতুন বিনিয়োগকারী আকৃষ্টের লক্ষ্যে সিডিবিএল, DSE ও CSE-এর কমিশন চার্জ কমাতে হবে এবং বাজারকে স্থায়ী স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে Market Stabilization Fund থেকে আইসিবিকে প্রদত্ত ফান্ড Time Deposit হিসেবে কোনক্রমেই Count করা যাবেনা। অর্থাৎ এই দ্বৈতনীতি পরিহার করতে হবে। এছাড়া, আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্বেও নো-ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
১২. পুঁজিবাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বিএসইসিকে দ্রুত পূনর্গঠন করতে হবে। এবং বিএসইসির কর্মকর্তাগণের পেশাদারিত্ব আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।