চাল-নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা নূর মোহাম্মদ
নিজস্ব প্রতিবেদক: চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় বাংলাদেশ। টানা চার বছর বাংলাদেশ এ অবস্থান ধরে রেখেছে। ছোট্ট এ ভূখণ্ডে খাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। সরকারও দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলে আসছে বারবার। নিচ্ছে নানান পদক্ষেপ। এরপরও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দিচ্ছে মাথাচাড়া। সাম্প্রতিক লোডশেডিং, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চাল উৎপাদনেও। গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে চালের দাম। স্বস্তি নেই মোটা চালেও। এতে সবচেয়ে বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ। সঞ্চয় শেষে তারা ঝুঁকছেন ধার-দেনায়।
এ অবস্থা বছরজুড়ে চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও বড় সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর নিমতলীতে একটি বাসায় কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করেন নূর মোহাম্মদ। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তিনি রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। ছেলের বয়স দুই বছর। আর ১২ বছর বয়সী মেয়ে পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। দুই সন্তান ও গৃহিণী স্ত্রীকে নিয়ে মাত্র ৯ হাজার টাকা বেতনের চাকরি দিয়েই চলে তাদের চারজনের সংসার।
গত কয়েক মাসে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় টানাটানির মধ্যেই চলছে সংসার। আগে ৯ হাজার টাকা দিয়ে তার সংসার চললেও এখন প্রতি মাসেই ধার করতে হয়। খরচ কমাতে বাজারে তুলনামূলক কম দামের গুটি স্বর্ণা চালই কিনছেন তিনি। মাত্র চার মাস আগে যেখানে ৪৫ টাকা কেজি দরে কিনতেন, সেই চাল এখন ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় কিনতে হয়। আর এক বছর আগে এই চালই কিনতেন ৩৫ টাকা কেজিতে।
নূর মোহাম্মদের চারজনের সংসারে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি চাল লাগে। ৩০ কেজি চালে আগে যেখানে ১২-১৩শ টাকা খরচ হতো, সেই খরচ এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬-১৮শ টাকায়। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আগে যেখানে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা লাগতো, এখন তার ব্যয় হয় ছয় থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা।
আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ায় এখন ধার-দেনা করে মাস চালাতে হয়। গত কয়েক মাসে ৩ হাজার টাকা ধার করেছেন তিনি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দিন দিন দেনা বাড়তে থাকবে বলে জানান নূর মোহাম্মদ।
নূর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বাড়ি-গাড়ি বা ধন-দৌলত চাই না। আমরা চাই খেয়ে-পরে যেন বাঁচতে পারি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বাঁচতে পারলেই হইছে। চাল-ডাল-তেলের দাম কমলেই হবে।
প্রতি মাসেই দেনা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে কোনো মাসে হাতে ৫শ টাকা বা ১ হাজার টাকা থাকতো। গত কয়েক মাসে সব জিনিসের দাম বাড়ায় এখন সেই টাকা তো থাকেই না, উল্টো ধার করতে হয়।
এদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কার্ডের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়ার বিষয়ে নূর মোহাম্মদ বলেন, প্রতি মাসে একবার করে টিসিবির চাল, ডাল কিনতে পারি। তাও পাইতে অনেক কষ্ট হয়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কেয়ারটেকারের কাজ করে লাইনে দাঁড়িয়ে কেনাও সম্ভব হয় না।
প্রকৃতপক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন নূর মোহাম্মদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে গ্রামে কৃষি উৎপাদন ও রেমিট্যান্সের টাকা বেশি আসায় সেখানকার নিম্ন আয়ের মানুষের তুলনায় শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের প্রভাব বেশি পড়েছে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারের বিভিন্ন ভাতা যেগুলো রয়েছে সেগুলো শহরে তেমনটা নেই। ফলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শহরেও যেসব এলাকায় শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষ বাস করেন সেখানে স্থানীয় সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চিকিৎসাসেবায়। তারা সরকারি হাসপাতালগুলোতে তেমন চিকিৎসাও পান না। কিছু কিছু জায়গায় সেবা পেলেও গ্রামের মতো শহরেও কমিউনিটি হেলথ সেন্টার চালু করা উচিত। আমরা এক গবেষণায় দেখেছি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় নিম্ন আয়ের মানুষকে পকেট থেকে দিতে হয়। এতে তাদের হাতে তেমন কিছু আর থাকে না।
বর্তমান সংকট মোকাবিলার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন এক কোটি পরিবারকে কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার কার্ড দেওয়া হয়েছে। এই কার্ড ভাসমান মানুষ কিংবা গরিব মানুষগুলো কতজন পেয়েছে তা জানি না। আগামী ছয় মাসের জন্য হলেও এই ভাসমান ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর কার্ড দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে আরও এক কোটি কার্ড দেওয়া উচিত।
‘এগুলো কারও না কারও দেখা উচিত। প্রতিটি ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা তৈরি করা উচিত এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কমমূল্যে কেনার জন্য একটা করে দোকান রাখা যেতে পারে, যাতে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন। আমাদের এখন সমস্যা হচ্ছে আমদানির। তবে আমদানি পণ্যের মধ্যে খাদ্য আমদানির ব্যাপারে সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে।’ যোগ করেন ড. আতিউর রহমান।