বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেশের অর্থনীতিকে করেছে শুষ্ক
শাহ আলম নূর: বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেশের অর্থনীতিকে করেছে শুষ্ক। একই সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও দেশের অর্থনীতির উপ ফলেছে নেতিবাজক প্রভাব। বিশ^ মন্দার কারনে এক দিকে দেশের অর্থনীতি যেমন শুষ্ক করে দিয়েছে। তেমনি ব্যবসা, বাণিজ্যে চলছে মন্দার প্রভাব। এতে দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমাগত ঘাটতির দিকে যাচ্ছে।
বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা গত বছরের শুরু থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এটি দেশের বাণিজ্য খাতকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। ডলারের দামের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির সাথে সরবরাহ ব্যবস্থায়ও ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। বিশ^ বাণিজ্যে অস্থিরতার কারনে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও পণ্যের দাম করেছে উর্ধ্বমুখি। এতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি।
দেশের ব্যাংকিং খাত প্রায় সারা বছরই আমদানি বিল পরিশোধে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যা প্রত্যক্ষ ও পরক্ষ্যভাবে ব্যবসা ও ভোক্তাদের প্রভাবিত করেছে। এক বছরের ব্যবধানে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৪.৪১ শতাংশ।
দেশের রপ্তানিকারকরা এই অবমূল্যায়নের ফলে লাভবান হলেও আমদানিকারক ও ভোক্তারা হয়েছে ক্ষতির সম্মুখীন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ডলারের ঘাটতির কারণে কাঁচামাল আমদানিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে।
ডলারের ঘাটতি মেটাতে, দেশের ব্যাঙ্কগুলি চলতি অর্থ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভ থেকে সহায়তা হিসাবে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক এই অর্থবছরের পাঁচ মাসে ব্যাংকগুলিতে আরও ৫ বিলিয়ন ডলার ইনজেক্ট করা হয়েছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সানেম’র নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমি বলব বছরটা গেছে এক ধরনের মিশ্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। অন্তত দুটি বড় বিষয় অর্থনীতিতে ব্যাপক আলোচনায় ছিল। এর একটি মূল্যম্ফীতি। উচ্চ হারের মূল্যস্ম্ফীতি ছিল প্রায় বছরজুড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই এ সংকটে পড়তে হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে যা খুব চাপে ফেলে দেয়। অন্যটি হচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের কারণে তৈরি হওয়া চাপ। ডলারের দরে বড় উল্লম্ম্ফন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির এ ধরনের চাপ আমরা গত এক দশকের মধ্যে দেখিনি। অন্যদিকে আশাব্যঞ্জক দিক ছিল পদ্মা সেতু। গত জুনে এই সেতু উদ্বোধনের পর তা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব আনার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আরেকটি ইতিবাচক দিক বছরের শেষ দিকে মেট্রোরেল চালু হওয়া। সামগ্রিকভাবে অবকাঠামো উন্নয়নে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখেছি। ফলে সংকট এবং সম্ভাবনার একটি মিশ্র বছর কাটল আমাদের।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্বাভাবিক বড় ঘাটতি দেখা গেছে বছরটিতে। রপ্তানি বেড়েছে ঠিক। তবে আমদানি বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। যদিও সরকারের নানা পদক্ষেপে বছরের শেষ দিকে আমদানি কিছুটা কমে এসেছে। ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। আগামীতে আমদানি আরও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা প্রশমন এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর যে চাপ এসেছে তা কিছুটা সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা। রপ্তানি বেড়েছে। ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু বড় উদ্বেগের জায়গা হলো, বিশ্বজুড়ে একটা মন্দা অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান বাজার উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে মন্দার একটা পূর্বাভাস রয়েছে। সেটি হলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে সমস্যা হতে পারে।
তিনি বলেন আমাদের এখানে দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ডলারের সংকট এলো। রেমিট্যান্স ব্যাপক হারে কমে গেল। তখন ডলারের দামের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলো। ফলে এবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিমভাবে ধরে রাখলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে থাকে। সুতরাং কৃত্রিমভাবে টাকার মান ধরে রাখা উচিত নয়। এটিকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক জায়গায় ধরে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, তিন থেকে চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই সেটি স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সেটি স্বাভাবিক সময়ের জন্য। অস্বাভাবিক অবস্থায় এটি সে রকম নয়। সুতরাং আমাদের শিক্ষণীয় হচ্ছে, সংকটকালে ৮ থেকে ১০ মাসের আমদানি দায় মেটানোর ব্যবস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে রিজার্ভকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বর্তমান রিজার্ভ ১১ মাসের আমদানি দায় মেটাতে সক্ষম।
এবারের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে আমাদের আরও শিক্ষণীয় হচ্ছে- অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন এ ধরনের সংকট মোকাবিলায়। সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে করব্যবস্থা, ব্যাংক খাত ও বাণিজ্যনীতির সংস্কার দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারেও প্রয়োজন রয়েছে সংস্কারের। এসব সংস্কার যথাযথভাবে করা হলে এ ধরনের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতি এলে তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।
সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আগামী বছর আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুটি চালক হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। দুটি খাতই বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। যেসব দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়, সেখানে সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানিতে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক পথে দেশে আসছে না। হুন্ডির ডলার দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে না। এসব বিষয় বিবেচনায় বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে ভালো নজর রাখা এবং সে অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য সব ব্যবস্থা রাখতে হবে। মূল্যস্ম্ফীতির কারণে চাপে পড়া মানুষদের সুরক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।