আজ: শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ইং, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৫ জানুয়ারী ২০২৩, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

বাড়ছে মূল্যস্ফীতি

মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে বাড়তি মজুরি

শাহ আলম নূর : করোনার কারণে সংকটে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বাড়ানো হয়েছে। তবে সেই বাড়তি মজুরির অর্থ খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা সূল্যস্ফিতি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি। সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কুলনায় কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপটে এ প্রবণতায় টান পড়েছে।
মূল্যস্ফীতির কারনে সাধারণ মানুষ তাদের বেশি অর্থ ব্যয় করছে। মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারা মূল্যের তুলনায় সেবা পাচ্ছেন অনেক কম।
সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে আর খাদ্য বর্হিভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গ্রামে এই হার শহরের তুলনায় বেশি। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি।
অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’র সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি দিয়ে আমরা যেটা বুঝি তা হলো, কোন একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে? যেমন ধরুন একটা জিনিসের দাম ২০২০ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। সব জিনিসের দাম তো একইরকমভাবে বাড়ে না। বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন বেতন এবং মূল্যের ব্যবধানের ফলে সীমিত আয়ের মানুষ যারা বেশিরভাগই তাদের পরিবারের উপার্জনকারী তারা ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে বাড়তে পারে দারিদ্র্যের হার, একই সাথে বৃদ্ধি পেতে পারে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অপর দিকে বাড়তে পারে অপুষ্টির সংখ্যা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায় মূল্যস্ফীতির তুলনায় ২০২২ সালের নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল খুব কম।
নভেম্বরে নামমাত্র মজুরি বৃদ্ধির হার পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ৬.৯৮ শতাংশ ছিল। যদিও মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে ব্যবধান প্রায় ১.৮৭-শতাংশ।
উল্লেখিত সময়ে কৃষি খাতের নামমাত্র ৬.৯৫ শতাংশ বেড়েছে। মাছ ধরার ৪.৪৬ শতাংশ, শিল্প ৭.০৬ শতাংশ, নির্মাণ খাতে ৫.৫২ শতাংশ এবং পরিসেবা খাতে ৭.১৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
শুধুমাত্র উৎপাদন খাতের কর্মীরা মুদ্রাস্ফীতির হারকে হার মানিয়েছে। কারণ এটি নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির ৮.৮৫ শতাংশের বিপরীতে মুজুরি ৯.৬১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।
বিবিএস মজুরি হার সূচক (ডব্লিউআরআই) প্রবণতা এবং মজুরি উপার্জনকারীদের সামগ্রিক মজুরির পরিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক হিসাবে দেখানো হয়েছে। মজুরি সূচকটি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সময়ের সাথে স্বল্প বেতনের দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরির গতিবিধি পরিমাপ করার উদ্দেশ্যে। এটি প্রকৃত মজুরির পরিবর্তন পরিমাপ করতেও ব্যবহৃত হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন যে মজুরি বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অতীতে কোন ব্যবধান ছিল না। এবং কিছু ক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ব্যবধান এখন প্রশস্ত হচ্ছে। দু’টি প্রান্ত পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তারা মনে করছেন যে উদ্যোক্তাদের উপর মজুরি বৃদ্ধির চাপ ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ তারা রপ্তানি হ্রাসের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আইএফসি-এর প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ ডঃ এম মাসরুর রিয়াজ বলছেন, “মূল্যস্ফীতি প্রকৃত আয়কে হ্রাস করায় দরিদ্ররা তাদের ক্রয় ক্ষমতা হারিয়েছে।” ব্যবধানের ফলে দারিদ্র্যের হার আরও বিস্তৃত হতে পারে। নিম্নমানের খাবারের ফলে দেশে অপুষ্টি বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন সরকার বিদ্যুৎ বিল সহ ইউটিলিটি বিলগুলিতে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। একই সাথে দরিদ্রদের জন ওএমএস এবং পাবলিক-ট্রান্সপোর্টেশন সুবিধা প্রসারিত করতে পারেন।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর মোস্তফা কামাল মুজেরি বলেন, মুদ্রাস্ফীতির হার যদি নামমাত্র মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তাদের প্রকৃত আয় কমে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতি মানুষের বিশেষ করে সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানকে নিম্নমুখী করে।
ডাঃ মুজেরি উল্লেখ করেছেন যে দেশে কিছু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি রয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান দামের সাথে মানিয়ে নিতে মাসিক বা বার্ষিক বরাদ্দ খুবই দুর্বল।
তিনি মনে করেন বাংলাদেশের এখন একটি সার্বজনীন সামাজিক-সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন যা বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে এই ধরনের ধাক্কা মোকাবেলার জন্য ন্যায্য লক্ষ্যমাত্রার উপর ভিত্তি করে।
সাধারণত, দরিদ্র মানুষের মূল্যস্ম্ফীতি গড় মূল্যস্ম্ফীতির তুলনায় বেশি। কারণ খাদ্যপণ্য কিনতেই তাদের আয়ের বড় অংশ চলে যায়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের মোট আয়ের ৬০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্যপণ্য সংগ্রহে। এমনকি বিবিএসের তথ্যেও বলা হয়েছে, খাদ্য গ্রহণে মোট আয়ের ৪৭ শতাংশ ব্যয় হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল) নির্বাহী সদস্য শাকিল আক্তার চৌধুরী বলেন, নিত্যপণ্যের দর বৃদ্ধির কারণে প্রকৃত আয় কমেছে সাধারণ শ্রমিকদের। তারা কষ্টে আছে। মূল্যস্ম্ফীতি যেহেতু এখন বিশ্ব বাস্তবতা, সে কারণে দর কমানোর সুযোগ হয়তো কম। তবে আয় বাড়ানোর মাধ্যমে সাধারণ শ্রমিকদের একটু ভালো রাখা যায়। শ্রকিকের মজুরি বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে তারা বিভিন্ন ফোরামে আবেদন জানিয়েছেন। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) পক্ষ থেকে ঈদের পর এ ব্যাপারে সরকারকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.