টার্কি পালন করে লোকসানের সম্মুখিন হচ্ছে অনেকে
শাহ আলম নূর : টার্কি পালন করে লোকসানের সম্মুখিন হচ্ছে অনেকে। বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে দেশের টার্কি খামারিরা। বাচ্চার দাম কমে যাওয়া, খাদ্যের দাম বেশি এবং বড় ধরনের রোগবালাইয়ের আক্রমনে মড়ক লাগাসহ বহুবিধ সমস্যার কবলে পড়ে নিজ নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রায় শতাধিক খামার হতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। খাবারের দাম বেশি, ডিম ও বাচ্চার দাম কম এবং মাংসের চাহিদা তুলনামূলক না থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের। ফলে ধ্বংসের পথে এই টার্কি শিল্প।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশের বহু তরুণ বিশাল লাভের প্রতিশ্রুতি দেখে টার্কি পালন শুরু করেন। দেশে গড়ে ওঠে অনেকগুলো টার্কি খামার। কিন্তু কয়েক বছর পরই মুখ থুবড়ে পড়েছে সেসব উদ্যোগ। কিন্তু আশা দেখানো টার্কি ব্যবসা কেন ডানা মেলতে পারল না এদেশে?
২০১৯ সালের গোড়ার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে শ্বশুরবাড়িতে একচিলতে জমির ওপর একটা টার্কির খামার করেন ৪৩ বছর বয়সি আবু রাশেদ খান। ৭০টি তিন মাস বয়সি টার্কির বাচ্চা নিয়ে তিনি খামার শুরু করেন।
ছয় মাস পর ডিম দিতে শুরু করে পাখিগুলো। রাশেদ ফেসবুকের মাধ্যমে দুজন ক্রেতার কাছে সপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০টি ডিম বিক্রি করতে আরম্ভ করেন। একজন ক্রেতা পটুয়াখালীর, অপরজন জামালপুরের। তারাও খামার করার জন্য ডিম কিনতেন। শুরুতে রাশেদ প্রতি হালি ডিম বিক্রি করতেন ৪০০ টাকায়।
তিনি বলেন, ‘খামার খোলা নিয়ে আমি আসলেই দারুণ উত্তেজিত ছিলাম। কারণ ওই সময় লোকে টার্কি পালন আর এ থেকে কীভাবে ভালো টাকা আয় করা যায়, তা নিয়ে কথা বলছিল।’
প্রথম ছয় মাস বিক্রিবাট্টা ভালোই হলো। কিন্তু রাশেদের ব্যবসা বেশিদিন টিকল না। সহসাই টার্কির ডিমের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় এক বছরের মধ্যে তিনি লোকসান গুনতে শুরু করলেন। ‘আমার টার্কি যখন বেশি বেশি ডিম দিতে শুরু করল, তখনই বাজার পড়তে আরম্ভ করল,’ রাশেদ জানান।
নিজের সঞ্চয় ও শ্বশুরের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে তিনি খামার করেছিলেন। খামারে তার নিজের বিনিয়োগ ছিল প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ‘পুরো প্রজেক্টটাই লোকসান খেল,’ বলেন তিনি।
২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাশেদের মতো আরও অনেক তরুণ টার্কি পালন শুরু করেন। ওই সময় একের পর এক সাফল্যের কাহিনি শোনা যেতে থাকে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে টার্কি পালন। কিন্তু এই আলোড়ন বেশিদিন টিকল না। খামারিদের পুরো মনোযোগই ছিল ডিম পাড়া আর বাচ্চা ফোটানোর ওপর। টার্কির মাংসের বাজার ও এর ভোক্তা তৈরির দিকে তাদের নজর ছিল না।
‘আমাদের সমাজে খুব কম লোকেরই আট কেজি ওজনের একটা টার্কি কেনার সামর্থ্য আছে। আট কেজি ওজনের একটা টার্কির দাম পড়ে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার টাকা,’ রাশেদ জানান।
তিনি বলেন, গুজবে গা ভাসানোর কারণেই তার টাকা পানিতে গেছে। ‘আমিও ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখে [টার্কি খামার করতে] উৎসাহী হয়েছিলাম।’
অবশেষে ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে রাশেদ তার সর্বশেষ ৫০টি টার্কি কারওয়ান বাজারে বিক্রি করে দেন।
প্রাইভেট কার চালক আমির হামজার গল্পটাও একই রকম। ২০১৮ সালে তিনি ময়মনসিংহের ভালুকায় টার্কি পালন শুরু করেন। ওই সময় এক হালি ডিমের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু আমির তার খামার চালাতে পেরেছেন মাত্র দুই বছর।
আমির ১২টি টার্কি নিয়ে খামার শুরু করেন। শেষে তার টার্কির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫০-এ। বাংলাদেশে মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর টার্কি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
মহামারিকালে পশুচিকিৎসক পাওয়া কঠিন ছিল। ফলে ওই সময় প্রায় ১২০টি পাখি মারা যায়। বাকিগুলো আমির ৩৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করে দেন।
তিনি বলেন, টার্কি যেহেতু বাংলাদেশি খামারিদের জন্য নতুন জাতের পাখি, তাই তাদের বেশিরভাগই এর লালন-পালন, চিকিৎসা ও খাবার সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না।
আমির বলেন, ‘কিছু লোক ডিম আর টার্কি বেচে বিপুল লাভ করেছিল, কিন্তু কেউ এর মাংসের বাজার তৈরি করতে কাজ করেনি। ফলে বাজারটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।’
আমিরের একটি ইনকিউবেটর ছিল। তিনি ডিম ফুটিয়ে ১০ দিন বয়সি টার্কির বাচ্চা বিক্রি করতেন ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। বাচ্চার দাম নির্ভর করত আকারের উপর।
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য পোল্ট্রির সাথে তুলনা করলে টার্কির উৎপাদন খরচ বেশি। বেশিরভাগ টার্কি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, ২ শতাংশের বেশি প্রকল্প লাভজনক নয়।’
আমির জানান, টার্কি যে পরিমাণ খাবার খায় সেই অনুপাতে আকারে বাড়ে না, যেমনটা হয় ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে। এছাড়া টার্কির ওষুধও দামি। এমন কোনো কোম্পানিও নেই যারা তুরস্ককে কেন্দ্র করে ফিড বা ওষুধ তৈরি করে। বাংলাদেশে টার্কিদের সাধারণত ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খাবার দেওয়া হয়।
এছাড়া নিয়মিত খাওয়ার পক্ষে টার্কির মাংস অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি পুরুষ টার্কির ওজন প্রায় ১০ কেজি। আমির বলেন, ‘প্রতি কেজি টার্কির মাংসের পাইকারি দাম ৩৫০ টাকা। এ হিসাবে একটা টার্কির দাম দাঁড়ায় গড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। একটা সাধারণ পরিবারের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব না।’
ওজনে হালকা ও লাল মাংসের তুলনায় স্বাস্থ্যকর বিকল্প হওয়ায় পশ্চিমে টার্কি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশিরা সম্ভবত টার্কির মাংসের স্বাদ পছন্দ করেনি।
কেউ কেউ ‘টার্কির গন্ধ’ ঢাকতে মাটনের মতো অতিরিক্ত মশলা দিয়ে পাখিটির মাংস রান্নার করার চেষ্টা করেছিলেন। একটি প্রাইভেট কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সঞ্জয় দে বলেন, কয়েক বছর আগে তিনি টার্কির মাংস চেখে দেখেছিলেন, কিন্তু স্বাদটা তার কাছে তেমন ভালো লাগেনি।
ধানমন্ডির নিউ চিয়ার্স রেস্টুরেন্ট বছর চারেক আগে টার্কির মাংসের তরকারি বিক্রি করত। কিন্তু এখন তাদের মেনুতে আর খাবারটি নেই।
রেস্তোরাঁর কর্মচারী মোহাম্মদ নাদিম শেখ বলেন, ‘টার্কির চাহিদা নেই, তাই আমরা আর বিক্রি করি না।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র দাস ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে টার্কিসহ আরও কিছু অপ্রচলিত পাখির ওপর গবেষণা করেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে টার্কি পালনের সম্ভাবনা নিয়ে করা এই গবেষণায় পাখিটির পুষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক সুভাষ জানান, ২০১৬-২০১৭ সালে দেশে প্রায় ৫ হাজার টার্কি খামার হয়েছে।
দেশে টার্কির মাংসের চাহিদা কখনোই বাড়েনি। পরিণতিতে এর দাম গেছে কমে। খামারিরা লোকসান দিতে আরম্ভ করেন। ফলে টার্কির খামারের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ২০টিতে নেমে এসেছে।
অধ্যাপক সুভাষ বলেন, শুরুতে মানুষ বিনোদনের জন্য টার্কি পালন শুরু করে। তারা ভারত থেকে ডিম আমদানি সেগুলো থেকে বাচ্চা ফোটাত। টার্কি পালনে তাদের না ছিল কোনো অভিজ্ঞতা, না ছিল পাখিটির রোগবালাই সম্পর্কে কোনো জানাশোনা।
টার্কি পালন কেন কমেছে, জানতে চাইলে অধ্যাপক সুভাষ বলেন, এর মূল কারণ হলো খামারিরা শুধু ডিম ফুটানো এবং বাচ্চা বিক্রির কাজটাই করেছেন।
‘মাংসের চূড়ান্ত ভোক্তাদের কথা না ভেবে সবাই-ই যদি ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানোর পেছনে ছুটতে থাকে, তাহলে টার্কি পালন টিকবে কীভাবে?’ বলেন অধ্যাপক সুভাষ।
তিনি আরও বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক টার্কি দেখতে খুব একটা সুন্দর না, অনেকটা শকুনের মতো চেহারা। যা দেশে পাখিটির অজনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
তবে বাংলাদেশে এখনও টার্কি পালন পুনরুজ্জীবিত করার উপায় আছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক সুভাষ। এজন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে টার্কির চিকিৎসাব্যবস্থা ও মাংসের বাজার নিশ্চিত করতে হবে। চূড়ান্ত ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করার জন্যও প্রকল্প নিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) আবদুল আজিজ আল মামুন বলেন, আপাতত টার্কি পালনে সরকারের কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা নেই।
তিনি বলেন, ‘একসময় দেশে টার্কি চাষের প্রসার ঘটলেও তা টিকতে পারেনি। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা-সংক্রান্ত কিছু সমস্যা রয়েছে। আর টার্কির মাংসও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এ কারণে আমরা কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছি না।’