আজ: শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ইং, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

০৮ জানুয়ারী ২০২৩, রবিবার |

kidarkar

ডলার সংকটে আমদানি কমছে নিত্যপণ্যের

শাহ আলম নূর : ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অস্থিরতায় বেশ ভাভর ভাবে প্রভাব পড়েছে আমদানি বাণিজ্যে। ডলার সংকট ব্যাপক ভাবে আমদানি কমছে নিত্যপণ্যের। আমদানি বাণিজ্য কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য এখন আগের মতো অপেক্ষা করতে হয় না নাবিকদের। দিনে দিনে ভেড়ানো যায় কনটেইনারবাহী জাহাজ। এতে বোঝা যায় বৈদেশিক বাণিজ্যের বর্তমান প্রবণতা বেশ নেতিবাচক।
ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়ে দাম বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় আগামী রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়ে দাম বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ রমজান মাসে তেল, চিনি, সয়াবিন-পাম ওয়েল, ছোলা ও খেজুরের যে বাড়তি চাহিদা থাকে তা মেটানোর মতো এলসি খুলতে পারেনি ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভায় এলসি পরিস্থিতির যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা পর্যালোচনা করে আমদানি বাণিজ্যের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে।
সভায় ২০২১ ও ২০২২ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের এলসি খোলার তুলনামূলক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এই তিন মাসে র-সুগার আমদানির জন্য দেড় লাখ মেট্রিক টন কম এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ সবচেয়ে কমে গেছে।
একই অবস্থা সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় ক্রুড, পরিশোধিত ও সয়াবিন সিড হিসেবে। ক্রুড সয়াবিনের আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ১ লাখ ৬৭ হাজার টন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার মেট্রিক টনে।
সয়াবিন সিড আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ২০২১ সালে ছিল ৪.৭১ লাখ টন, যা ২০২২ এ নেমে এসেছে মাত্র ৭৮ হাজার মেট্রিক টনে। এই পরিস্থিতিতে এলসি খোলা স্বাভাবিক করতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ডলার সংরক্ষণের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।
সভায় ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, বারবার আশ্বাস সত্ত্বেও আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংকট দূর হয়নি। উল্টো ব্যাংকগুলোর আরোপিত বিভিন্ন শর্তের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্যের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বাড়ছে। ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি এড়াতে দেশে নিত্যপণ্যের আমদানিতে প্রয়োজনীয় এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলার সরবরাহে বিশেষ কোটা সুবিধা চেয়েছেন তারা।
এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার সুবিধার্থে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার রাখার প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হবে। তবে নিত্যপণ্যের আমদানিতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তার জন্য কেইস টু কেইস ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের এলসি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জোরালো পদক্ষেপ নেবে। এর ফলে আমদানিকারকরা ক্ষেত্রবিশেষে এলসি ছাড়াই বিশেষ ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট পণ্য আমদানি করতে পারবেন।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষও বলেন, ‘প্রয়োজনে এলসি (ঋণপত্র) ছাড়াই পণ্য আমদানির কিছু অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। কেউ যদি এলসি নিয়ে জটিলতায় পড়েন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানালে বিবেচনা মতো অনুমতি দিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি জানান, আসছে এপ্রিলের শুরুতে রমজান মাস শুরু হবে। সেই হিসাবে হাতে এখনও তিন মাস সময় আছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল, চিনিসহ আরও কিছু পণ্যের এলসি খোলার পর সেই পণ্য এনে খোলাবাজারে সরবরাহে দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে।
জানা গেছে, পাম অয়েলের এলসি খোলার পরিমাণ নেমেছে একেবারেই তলানিতে। এসব পণ্যের এলসি এখনই খুলতে না পারলে রমজানের আগে পণ্য আনা কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
পেঁয়াজ ও মসুর ডালের এলসি খোলার পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও ছোলা ও খেজুর আমদানির এলসি ওপেন করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। যে কারণে এগুলোর সরবরাহ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা দেড় লাখ মেট্রিক টন, যেখানে রমজানে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লাখ মেট্রিক টনে। একইভাবে চিনির মাসিক চাহিদা দেড় লাখ টন থেকে বেড়ে তিন লাখ মেট্রিক টনে গিয়ে দাঁড়ায়। মসুর ডালের মাসিক চাহিদা ৪০ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ১ লাখ টন, পেঁয়াজের চাহিদা ২ লাখ টন থেকে বেড়ে ৪ লাখ টন, রমজানে ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন এবং খেজুরের চাহিদা ৫ হাজার টন থেকে বেড়ে ৫০ হাজার টনে পৌঁছে।
সভায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এলসি সেটেলমেন্টের চিত্র তুলে ধরা হয়। এই চিত্রেও দেখা গেছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চিনি, ক্রুড পাম অয়েল, ছোলা ও খেজুরের আমদানি কমে গেছে। বাকি সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে।
এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন ‘আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চিনির ওপর ডিউটি কমানোর জন্য এনবিআরকে সুপারিশ জানিয়ে শিগগিরই চিঠি পাঠানো হবে।’
তিনি বলেন ‘রমজানে চাহিদাযোগ্য কোনো নিত্যপণ্যের সংকট নেই। ভোজ্যতেল, ছোলা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি এবং খেজুর সবগুলোরই দেশে পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুত রয়েছে। কিছু পাইপলাইনে রয়েছে। নতুন করে এলসিও খোলা হচ্ছে কিছু পণ্যের। তবে শেষ পর্যন্ত কতটা স্বাভাবিক রাখা যাবে তা নির্ভর করবে ডলারের দাম কত থাকে তার ওপর। আশার বিষয় হচ্ছে, এটার দাম এখন কমতির দিকে।’

টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাতে রমজানে পণ্যের সরবরাহে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে একটা ভয় সব সময় কাজ করে-সেটি হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের প্রতি ক্রেতা-ভোক্তার অতি চাহিদা। এটার কারণে বাজারে ওই পণ্যটির সরবরাহে ঘাটতি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে দামও বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে যে সকল পণ্য আমদানি করে থাকি সেগুলো পূর্বে না জানিয়ে হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ না করার বিষয়ে ভারত সরকারকে জানানো হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশের চাহিদা মোতাবেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে ভারত সরকার। সবদিক বিবেচনায় বলা যায়, আগামী দিনগুলোতে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন পণ্যের সংকট হবে না, মূল্য স্বাভাবিক থাকবে।’
সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘দেশের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্বাভাবিক মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে।’
টাস্কফোর্সের সভায় ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, রমজানে বাড়তি চাহিদা কেন্দ্রিক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিশেষ করে চিনির এলসি তুলনামূলক কম হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনাক্রমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রয় হচ্ছে না তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে চিনির উপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাবও করা হয়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারদরের সাথে স্থানীয় বাজারদরের যথাযথ সমন্বয় হচ্ছে না বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রমজান পর্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসব পণ্যের এলসি খুলতে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে।
এদিকে দেশের রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে আমদানিতে নানা শর্তারোপের ফলে আমদানির পরিমাণ ব্যাপক কমছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত) আমদানি এলসি ওপেনিং কমেছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপের পর গত বছরের জুন মাস থেকে এলসি ওপেনিং কমছে।
জুনে এলসি ওপেনিং হয়েছে ৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার, জুলাই মাসে হয়েছে ৬.৩৯ বিলিয়ন, অক্টোবরে হয়েছে ৪.৭৪ বিলিয়ন, নভেম্বরে হয়েছে ৪.০২ বিলিয়ন ও ডিসেম্বরে হয়েছে ৪.১১ বিলিয়ন ডলার।
একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “দেশের রিজার্ভকে সহনীয় রাখতে ও বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমাতে আমদানি কমানোর বিকল্প নেই। তবে এখন প্রতি মাসে চার বিলিয়ন করে যে পণ্য আমদানি হচ্ছে এটা আমাদের দেশের জন্য অপুষ্টিকর। আমদানিকে আরও বাড়িয়ে ৬.৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাখতে হবে।”
এদিকে, আগামী সোমবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) ১.১২ বিলিয়ন ডলার পেমেন্টের পর দেশের রিজার্ভ ৩২.৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এখন ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে রিজার্ভ থেকে ৭.৪৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে, যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির রেকর্ড ৭.৬৭ বিলিয়নের।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.