সৌদির শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় লাভবান হবেন বাংলাদেশি কর্মীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছর সৌদি আরবের শ্রমবাজার উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হওয়ার পূর্বাভাস মিলেছে; এতে দেশের জনশক্তি নিয়োগকারী সংস্থাগুলো আশা করছে, এ বছর উপসাগরীয় দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
দুবাই-ভিত্তিক রিক্রুটমেন্ট কনসালটেন্সি ফার্ম কুপার ফিচের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সৌদি আরবের ৫৭ শতাংশ কোম্পানিই আগামী ১২ মাসে তাদের কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
জরিপ করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কর্মীদের বেতন ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর এবং প্রায় এক চতুর্থাংশ কোম্পানি কর্মীদের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে।
এদিকে আবার, স্থানীয় কর্মীদের নিয়োগ আরও বাড়াতে ‘সৌদিকরণ’ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে দেশটির সরকার; তা সত্ত্বেও স্থানীয় জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লো-স্কিলড বা দক্ষতা কম হলেও চলে এমন চাকরির জন্য দেশটিতে অভিবাসী শ্রমিকের চাহিদা কমবে না।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “সৌদি আরব মূলত বাংলাদেশি শ্রমিকদের লো-প্রোফাইল চাকরিতে যেমন- নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী ইত্যাদি কাজে নিয়োগ করে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে তারা তাদের স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদাও সেখানে অব্যাহত থাকবে।”
এই খবরগুলো মূলত বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ লুফে নেওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চলতি বছরে রেকর্ড ১৫ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠাতে চায় বাংলাদেশ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর প্রায় ৬ লাখ ১২ হাজার কর্মী উপসাগরীয় দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন।
গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শীর্ষ গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। গেল বছর ১১ লাখ ৩৫ হাজার বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৫৪ শতাংশই তৈরি হয়েছে সেখানে।
কুপার ফিচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালে ৪৩ শতাংশ সৌদি নিয়োগকর্তারা মজুরি ৩ শতাংশের ওপরে বাড়িয়ে বেতন সমন্বয়ের পরিকল্পনা করছেন, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এবং দেশের শ্রমবাজারের জন্য একটি ভালো খবর।
কুপার ফিচের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ট্রেফর মারফি আরব নিউজকে বলেছেন, “এই পরিসংখ্যানটি শুধুমাত্র আমাদের সমীক্ষার মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং বিগত বছরে বাজারে বৃহত্তর নিয়োগের প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।”
“সৌদি আরবের অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে; আমরা আশা করছি, উন্নয়ন এবং কর্ম বৈচিত্র্যতার এই ধারা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকবে,” যোগ করেন মারফি।
২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে সৌদি আরবে রেকর্ড ৩৯.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) চলতি ২০২৩ সালে দেশের বিনিয়োগ খাতে বৈচিত্র্য বাড়ানোর কথা ভাবছে।
তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। গেল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত দেশটির বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮.৬ শতাংশ।
এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়ছে; বিশেষ করে প্রাইভেট ইকুইটি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইত্যাদি খাত আরও বড় হচ্ছে।
স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সির পরিচালক খালেদ হোসেন বলেন, “সৌদি নিয়োগকর্তারা আরও বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে চাইছেন।”
খালেদ হোসেন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবে একটি জব ফেয়ারে অংশ নিয়েছিলেন; সেখানে তিনি বাংলাদেশ থেকে আরও কর্মী আনার ব্যাপারে সৌদি নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন।
“বর্তমানে আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে প্রতিমাসে ২০ থেকে ৩০ জন শ্রমিক ন্যূনতম ২২ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে সৌদি আরবে যাচ্ছেন। আমরা মাইগ্রেশনের জন্য কর্মীপ্রতি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা চার্জ রাখি,” তিনি বলেন।
ব্রিটিশ নিয়োগ বিশেষজ্ঞ হেইসের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আরবের শিল্প খাতের উন্নয়ন ২০২৩ সালে দেশটির শ্রমবাজারকে আরও সম্প্রসারিত করবে। উপসাগরীয় দেশটির সরকার সম্প্রতি নানান উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেমন- নিওমে ৭৫-মাইলের মেগা-সিটি নির্মাণসহ দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান শপিংমল, দোকানপাট স্থাপনের প্রবণতা সৌদির শ্রমবাজারকে আরও সম্প্রসারিত করে তুলবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কারণ এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশটির বিভিন্ন শিল্পখাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যম থেকে সিনিয়র পর্যায়ের সৌদি ও প্রবাসী পেশাজীবীরা, যারা চাকরি পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক, তাদেরকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে চাকরির বাজারের এই সম্প্রসারণের পিছনে ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস প্রোগ্রামকে মূল চালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই প্রোগ্রামের ‘সৌদিকরণ’ পসিলির আওতায় অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু খাত ও পেশায় সৌদির নাগরিকদের জন্য উচ্চ কোটা সংরক্ষণের চাপ রয়েছে।
এর ফলে মধ্যম থেকে সিনিয়র পর্যায়ে চাকরির ক্ষেত্রে সৌদি নাগরিকদের চাহিদা বাড়লেও প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের এই মেগা-প্রকল্পগুলোতে শুধু স্থানীয় নয়, বরং সারাবিশ্ব থেকেই দক্ষ লোকদের প্রতিভা নিয়োগের প্রয়োজন।
সৌদি সরকারের ভিশন ২০৩০-এর আওতায় এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরিচালিত হচ্ছে; এর মাধ্যমে হাইড্রোকার্বনের ব্যবহার কমিয়ে সৌদি অর্থনীতিকে অন্যান্য কর্মখাতে বৈচিত্র্যময় করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিগত চার বছরে ১০ হাজারেরও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে।