নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা আজ
মুদ্রানীতিতে নীতি বদলাবে কি?
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ব্যাংকে যত টাকা জমা আছে তার ৮৮ শতাংশই মেয়াদি আমানত, যা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে উত্তোলন বা নবায়ন হয়। আর ১২ শতাংশ ডিমান্ড ডিপোজিট, যে আমানত নিয়মিত জমা ও উত্তোলন হচ্ছে। গত ডিসেম্বর শেষে মেয়াদি আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এর আগে ১৯৭৪-৭৫ সালে তা ৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ।
আমানতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় কিছু ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়েছে। তাতে কলমানি বাজারে সুদহার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে টাকা ধার করছে, আমানতের সুদও বাড়িয়েছে। ঋণ অনিয়মের বিষয় আলোচনায় আসায় বেশি তারল্যসংকটে পড়েছে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের সীমা নির্দিষ্ট হওয়ায় তারল্যসংকটে পড়েছে আরও অনেক ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়ে থাকে, তা মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ কেউ ঋণ কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ রোববার ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। এর মাধ্যমে আবারও বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার পুরোনো পথে ফিরছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এমন একসময়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে, যখন ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ ঢাকা সফরে রয়েছেন। আজ গভর্নরের সঙ্গে তাঁর সভা করার কথা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নীতি সুদহারে পরিবর্তন আনা হবে। তবে ব্যাংকঋণের সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা বহাল থাকবে। ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করার বিষয়টি থাকবে আলোচনায়।
আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের সীমা বাড়ানো হবে না। সরকারের ঋণের যে চাহিদা রয়েছে, আগামী ছয় মাস কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বড় অংশ জোগান দেবে। এ ছাড়া পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে শিল্প খাতের পাশাপাশি কৃষি ও এসএমই খাতে অর্থায়নে বেশি জোর দেওয়া হবে।
মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হলেও ব্যাংকিং খাতে এখন ডলারের পাশাপাশি টাকার সংকট, টাকার মান কমে যাওয়া, আমানতকারীদের আস্থার সংকটও প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ডিসেম্বরে ব্যাপক মুদ্রা (ব্রড মানি-এম২) বা গ্রাহকের আমানত ও ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, যদিও লক্ষ্য ছিল ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির। এর মধ্যে মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশ, ডিমান্ড বা স্বল্পকালীন আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০২০ সালের জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ।
গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে স্বল্পকালীন আমানত ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। আর একই সময়ে মেয়াদি আমানত কমে হয়েছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া মানুষের হাতে রাখা টাকা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপানো মুদ্রা বা রিজার্ভ মানির প্রক্ষেপণ ছিল ৯ শতাংশ, নভেম্বর পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, নভেম্বর পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকলেও নভেম্বরেই তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নভেম্বরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সরকারি খাতের ঋণও বাড়ছে।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকে টাকার টানাটানি শুরু হয়েছে সুদহার বেঁধে রাখা ও অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়। এই দুই বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঋণের যথাযথ মান নিশ্চিতের পাশাপাশি সুদহারের সীমা বাড়ানো বা তুলে দিতে হবে। ডলার-সংকট মেটাতে উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে নতুন মুদ্রানীতিতে।
গত ৩০ জুন চলতি অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বলা হয়েছিল ঘোষিত মুদ্রানীতির মেয়াদ হবে এক বছর। তবে আইএমএফের চাপে আবারও বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার আগের নিয়মে ফিরছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আগের মুদ্রানীতিতে পুরো অর্থবছরে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ২ শতাংশ।
মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছিল ১২ দশমিক ১ শতাংশ ও রিজার্ভ মুদ্রা ৯ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছিল সরকার। কিন্তু গত ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, মুদ্রানীতির কার্যকারিতা নির্ভর করবে সব ধরনের সুদহারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, তার ওপর। এ নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে তারল্য পরিস্থিতির এই হাল হয়েছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে হস্তক্ষেপ করছে। সুদহার তুলে দিতে না পারলে সোনার খাঁচার মধ্যে ছটফট করবে মুদ্রানীতি।