আজ: শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ইং, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সর্বশেষ আপডেট:

১৯ জানুয়ারী ২০২৩, বৃহস্পতিবার |

kidarkar

বিনিয়োগ মন্দায় বাড়ছে বেকারত্ব

শাহ আলম নূর : বিনিয়োগ মন্দায় দেশে বাড়ছে বেকারত্ব। একই সাথে কমছে উৎপাদনশীলতা। এতে হ্রাস পাচ্ছে শ্রমের মূল্য। কাঁচামালের ঘাটতিতে শিল্পখাতে অস্থিতিশীলতা; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে ব্যবসার খরচ বাড়া; এবং কোভিডের ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে চাকরির ক্ষেত্র তৈরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
বিশ্ব মন্দার সাথে দেখা দিয়েছে বিনিয়োগ মন্দা। বাংলাদেশের বেকারত্বের হার সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। গত নভেম্বর মাসে দেশের বেকারত্বের হার ৬.৯১ শতাংশে পৌঁছায়। অর্থাৎ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চ হলেও তা তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরি তৈরি করার মতো যথেষ্ট হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুলাইয়ে দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৬.৪৭ শতাংশ। এরপর তা নভেম্বরে বেড়ে এ নতুন উচ্চতায় দাঁড়ায়। এর আগের দুই দশকে ৪.২ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ বেকারত্বের হারের তুলনামূলক মৃদু পরিস্থিতির পর এমন বৃদ্ধি দেখা গেল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য-উপাত্তের বরাত দিয়ে ‘ইকোনমিক সিচুয়েশন রিভিউ অ্যান্ড পসিবল স্ট্র্যাটেজিস’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশনে বেকারত্বের নতুন এ হারের তথ্য প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিবিএস-এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিবিএস সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ পরিচালনা করেছিল।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ইন্ডাষ্ট্রি এন্ড লেবার উইং-এর পরিচালক কবির উদ্দিন আহাম্মদ জানান, সংস্থাটির কাছে বর্তমানে গত বছরের চার প্রান্তিকর বেকারত্ব বিষয়ক তথ্যউপাত্ত রয়েছে।
তিনি বলেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার আগে প্রয়োজন হওয়ায় বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে প্রক্রিয়াজাত না করা উপাত্ত সরবরাহ করার তাদের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে বলেও তিনি জানান।
২০১৬-১৭ সালের জরিপে পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্বের হার পেয়েছিল ৪.২ শতাংশ। কিন্তু, গত বছরের নভেম্বরে এ হার ২.৭১ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
২০০০ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৩ শতাংশ। এরপর এ হার গত দুই দশকে ৪.৫ শতাংশের বেশি কখনো ছাড়ায়নি।
যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ ৩-৫ শতাংশ বেকারত্বের হারকে আদর্শ হিসেবে মনে করেন, কিন্তু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো একক নেই। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ হারটি কোনো স্থিতিশীল নয় বরং গতিশীল লক্ষ্যমাত্রা। আর এর পরিবর্তন হয় অর্থনীতির লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, বিশেষত যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন, তারা কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় কাজ হারিয়েছেন।
কোভিডের ধাক্কায় কাজ হারানোর পর আবার কাজ খুঁজে পাওয়ার আগেই অনেক মানুষকেই নতুন বৈশ্বিক সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। এর ফলে চাকরির এ সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
এছাড়া দেশে বৃহৎ পরিমাণে উদ্বৃত্ত শ্রম বিদ্যমান অবস্থায় সরকারের পুঁজিঘন শিল্পগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতিতেও দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবিএস-এর জরিপ অনযায়ী, দেশের জাতীয় পর্যায়ের বেকারত্বের হারের তুলনায় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি।
দেশের ১৫-২৯ বছর বয়সী ১২.২৮ মিলিয়ন তরুণের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ পড়ালেখা, চাকরি বা প্রশিক্ষণের (নিট) আওতায় নেই বলে বিবিএস-এর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যে জানা গেছে।
এ ধরনের ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম তরুণের মোট সংখ্যা ৩৭.১ মিলিয়ন। কিন্তু, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুসরণ করে বিবিএস নিট শ্রেণিভুক্তদের, যারা কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ, তাদের বাদ রেখেছে।
এছাড়া, কোনোপ্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নন, এমন অনেক মানুষকেও বেকারত্ব হার নির্ধারণ থেকে বাদ রাখা হয়েছে।
বর্তমানে কোনো ব্যক্তি সাত দিনে একঘন্টা করে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে– তাকে একজন কর্মী হিসেবে গণ্য করা হয়।
অন্যদিকে, জরিপের সময়ে গত সাতদিনে কেউ কোনো কাজে জড়িত না থাকলে এবং কর্মসন্ধান করলে তাকে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
যেসব ব্যক্তি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রয়েছেন, তারা বিগত সপ্তাহে কাজের সন্ধান না করলেও তাদের বেকার হিসেবে গণনা করা হয় না।
দেশের বেশ কয়েকটি গবেষক সংস্থার মতে, করোনা মহামারি বিস্তার রোধে আরোপিত লকডাউনের সময় প্রতি চারটি কর্মসংস্থান/চাকরির মধ্যে তিনটি প্রভাবিত হয়েছে।
সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজি’স বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে যে, কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ৬১.৫৭ শতাংশ জনসংখ্যা কখনো না কখনো তাদের কর্ম হারিয়েছেন, যার অধিকাংশই ঘটেছে ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে, যখন লকডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ ছিল।
এছাড়া, কোভিড-পূর্ব সময়ে কর্ম নিয়োজিতদের প্রায় ৮৫ শতাংশ, যারা চাকরি হারান, তারা অন্তত এক মাস বা তার বেশি সময় বেকার ছিলেন।
২০২০ সালের জুলাইয়ে বিবিএসের টেলিফোনে পরিচালিত এক দ্রুত জরিপে ২২.৩৯ শতাংশ বেকারত্ব হার রেকর্ড করা হয়, যা প্রথম লকডাউন আরোপের আগে একই বছরের মার্চ মাসের ২.৩ শতাংশের তুলনায় ১০গুণ উচ্চ ছিল।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়– ২০২২ সালে দেশে ১৫ লাখ ২০ হাজার এবং বিদেশে ৬ লাখ ১০ হাজার– মোট ২১ লাখ ৩০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলে দেশের শ্রমবাজারে আসা ১৫ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও ৬ লাখ বেশি কর্মসংস্থান হতো।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর র‌্যাপিড টেলিফোন জরিপের তথ্যানুসারে, প্রথম লকডাউনের ছয় মাসের মধ্যেই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ বেকারত্ব হার দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়ে সেপ্টেম্বরে ৪ শতাংশে নেমে আসে।
তবে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া অভিঘাতগুলোর কারণে কর্মসংস্থান খাত বেশকিছু প্রতিকূলতারও সম্মুখীন হয়।
দেশের বৃহৎ অনলাইন জবপোর্টাল বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম মাশরুর বলেন, এই যুদ্ধে দেশের কর্মসংস্থান বাজার অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে।
আগের তিন মাসের তুলনায় গত তিন মাসে নতুন নিয়োগ ৩০ শতাংশ কমেছে বলে বিডিজবস ডটকমের তথ্যের বরাতে জানান তিনি। এই ধারা চলতি জানুয়ারিতেও অব্যাহত রয়েছে, এবং কিছু কোম্পানি কর্মী ছাঁটাইও করছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৯০% কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই খাত থেকে তৈরি হয় এবং এই খাতে নিয়োগ প্রায় প্রচুর।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জুনে রপ্তানি খাত ভালো করলেও, এসএমই এবং স্থানীয় বাজার-নির্ভর খাতগুলিকে কোভিড-পরবর্তী এই সময়ে দেখা দেওয়া বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপে সমষ্টিগত চাহিদাও সাম্প্রতিক সময়ে পতনের শিকার হয়েছে। কৃষি খাতের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক হলেও এই সময়ে শিল্পায়নে নেতিবাচক প্রভাবের ফলে কর্মসংস্থান কমে গেছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড়ে ৬.৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০০০-২০১৬ সালের ৬.০৪ শতাংশ গড়ের তুলনায় যা ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি।
তবে জিডিপির এই গড় প্রবৃদ্ধির বিকাশ, বেকারত্বের হার ৪.৫ শতাংশের নিচে বা সমতল হারে বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৬ সালের এক গবেষণায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানিয়েছে, প্রতিবছর দেশের কর্মসংস্থান বাজারে নতুন করে যুক্ত হতে আসছে প্রায় ১৮ লাখ ১০ হাজার কর্মী। আর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ হলেই তাতে তাদের সবার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। অথচ এই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার বাড়েনি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে থেকেই দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
‘অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রস্তুতকারক খাত। কিন্তু, বাংলাদেশের বেশিরভাগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি সেবা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত নির্ভর। একারণেই প্রস্তুতকারক খাত চালিত প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি’ বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ধারণা করছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির এই হারের আরও পতন হবে। এজন্য তিনি সরকারের ভুল বাণিজ্য নীতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে সরকার পুঁজিঘন শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশের মতো শ্রমসম্পদপূর্ণ দেশের জন্য যা সঠিক নীতি ছিল না।

আপনার মতামত দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.