কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য
খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে ৫১ ভাগ
শাহ আলম নূর : বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমান। তিন মাসে খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে ৫১ ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ শিথিল নীতির কারনে খেলাপি ঋণ অব্যাহত ভাবে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
২০২২ এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ১,৮৭৬ কোটি টাকা। যদিও আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুনে) আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩,৮৫৭ কোটি টাকা।
ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর সহজ নীতি ও ডলার সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা হওয়ায় খেলাপি ঋণ থেকে তিন মাসে আদায়ের পরিমাণ কমেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ১,৮৭৬ কোটি টাকা। যদিও আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুনে) আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩,৮৫৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে আদায় কমেছে ১,৯৮৭ কোটি টাকা বা ৫১ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে জোরদার হয় জুনে ও ডিসেম্বর সময়ে। সেপ্টেম্বর নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস হওয়ায় খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছুটা শিথিল ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের ঋণ বেশি হচ্ছে শিল্প খাতে। গত বছরের এপ্রিল থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে বিদেশে চাহিদা কম। একইসঙ্গে দেশের গার্মেন্টসে উৎপাদন কমে গেছে প্রায় ১৫-২০%। যার কারণে অনেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, “খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ শিথিল নীতি। ফলে দেখাচ্ছে খেলাপি বাড়ছে, আদায় কম হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য সার্কুলার ঠিক আছে। অন্যদিকে কিছু ব্যবসায়ী এটার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ করছে না। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা আসছে না এবং ব্যাংক নতুন করে লোন তৈরি করতে পারছে না।”
তিনি বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিলতা কমিয়ে আনা উচিত। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোর বার্তা দেয়া উচিত। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। আর ব্যবসায়ীদের উচিত নিজ ইচ্ছায় টাকা পরিশোধ করার মনোভাব তৈরি করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের পরিমাণ কমলেও ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২ এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ৫,৫৫১ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে ছিল ৩,৭০৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে কিন্তু খেলাপি ঋণ থেকে আদায় কমছে। কারণ এখন ব্যবসা-বাণিজ্য গত কয়েকমাস জুড়ে অনেকটা মন্দ যাচ্ছে। ছোট ছোট এসএমই উদ্যোক্তারা আমদানি করতে না পারায় তারা খেলাপি হচ্ছে, একইসঙ্গে ঋণও পরিশোধ করতে পারছে না।”
গত বছরের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পণ্য আমদানিতে লাগাম দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একের পর এক নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানিতে নানা শর্তের কারণে ২০২২ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত আমদানি এলসি ওপেনিং কমে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার।
কোভিডের কারণে ২০২০ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ওই সময়ে এক টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি হয়নি কেউ। পরের বছরও গ্রাহকেরা শিথিলতায় ঋণ পরিশোধের সুবিধা পায়।
এমনকি ২০২২ সালের শুরুর তিন মাস শতভাগ পরিশোধের শর্ত থাকলেও পরবর্তিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএমএসএমই ও শিল্প থেকে শ্রেণি বেঁধে ৫০-৭৫% পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়।
ব্রাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যখন কোন গ্রাহকের ঋণ দীর্ঘদিন খেলাপি থাকে সেই ঋণ পুনঃতফসিল করা ব্যাংকগুলোর জন্য প্রয়োজন। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ স্বাভাবিক হয় ও ঋণের কিছুটা আদায় হয়। তার পরামর্শ, ব্যাংকগুলোর উচিত খেলাপি ঋণ এড়াতে ভালো গ্রাহক দেখে ঋণ দেয়া।