ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীর ভাষা ছিল অশ্লীল, কুলিদের চেয়েও খারাপ : হাইকোর্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, সেদিন আইনজীবীদের ভাষা ছিল অশ্লীল। অল্প শিক্ষিত মানুষ এমনকি কমলাপুরের কুলিরাও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে না।
এ সময় আদালত উচ্চ আদালতের ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আইনজীবী নেতাদের উদ্দেশে বলেন, সারাদেশের আইনজীবীদের হাইকোর্টের মেসেজ জানিয়ে দেবেন আদালত অবমনা করলে, বিচারকদের সঙ্গে অসদাচারণ করলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা কিন্তু আইনজীদের সনদ আজীবনের জন্য বাতিল করতে পারি। আবার নমনীয়ও হতে পারি। এটাই আমাদের মেসেজ।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
এর আগে সকালে আদালতের তলবে হাজির হন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ২১ আইনজীবী।
তলব করা আইনজীবীরা হলেন- অ্যাডভোকেট মো. মফিজুর রহমান বাবুল, অ্যাডভোকেট মিনহাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক হাদি, নিজামুদ্দিন খান রানা, আনিছুর রহমান মঞ্জু, মো. জুম্মন চৌধুরী, রাশেদ মিয়া হাজারী, জাহের আলী, মো. আ. আজিজ খান, দেওয়ান ইফতেখার রেজা রাসেল, মো. ছদর উদ্দিন, মাহমুদুর রহমান রনি, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফুল হক মাসুদ, মীর মোহাম্মদ রাইসুল আহম্মেদ, মহিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া আহমেদ, মো. মোবারক উল্লা, মো. ফারুক আহমেদ, সফিক আহমেদ ও ইকবাল হোসেন।
শুনানির শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আমরা সময় প্রার্থনা করছি। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দুটি ঘটনায় জারি করা রুলের বিষয়ে আমরা একসঙ্গে শুনানি করতে চাই।
তখন হাইকোর্ট বলেন, দুটো ঘটনা তো আলাদা। ওটা (আদালতের ভেতরের ঘটনা) ছিল বেয়াদবি। আজকে যারা হাজির হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিন্ন। তারা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছেন।
এ সময় আদালত ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শিক্ষানবিশ দুই আইনজীবীকে সামনে ডেকে পরিচয় জানতে চান?
তারা নিচুস্বরে কথা বললে হাইকোর্ট বলেন, এখন এত নীচুস্বরে কথা বলছেন। বিচারকের বিরুদ্ধে স্লোগান তো উঁচুস্বরে দিয়েছেন। অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছেন। মেট্রিক পাস মানুষও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে না। এমনকি কমলাপুরের কুলিরাও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে না। কোনো রাজনৈতিক দলের ভাষাও এরকম হতে পারে না।
এ সময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল, বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আইনজীবীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাইলে হাইকোর্ট বলেন, যারা আদালত অবমাননা করে, আদালতের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করে আপনারা যখন তাদের পক্ষে আসেন, তখন আমরা লজ্জিত হই।
এ সময় বার সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল বলেন, সেদিনের প্রকৃত ঘটনা কি ছিল আমরা ব্যাখ্যায় আদালতের কাছে সব তুলে ধরবো।
তখন হাইকোর্ট বলেন, আপনারা কি কনটেস্ট করতে চাইছেন?
এ সময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, জুডিশিয়ারি আমাদের সবার। জুডিশিয়ারির মর্যাদা রক্ষা করার দ্বায়িত্বও আমাদের সবার।
হাইকোর্ট বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের অভিভাবক। আইনজীবীদেরও অভিভাবক। আপনাদের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্বও আমাদের। এ সময় হাইকোর্ট ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আদালতের অবস্থা জানতে চান।
তখন আইনজীবী নেতারা বলেন, এখন আদালত ভালোভাবে চলছে। আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়া যাব। সবার সঙ্গে কথা বলে সম্মানজনক সমাধানের চেষ্টা করব।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় বিচারকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতির সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, এই মামলায়ও সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে সবাই আমরা যাব। সবার সঙ্গে বসবো।
এ সময় আদালত ব্রাক্ষণবাড়িয়া বার সেক্রেটারিকে দেখতে চান। তিনি ডায়াসের সামনে এলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ঘটনার দিন বার সম্পাদক ছিলেন না।
তখন আদালত বলেন, কে কোথায় ছিলেন সব আমরা খুঁজে বের করব। প্রয়োজনে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেব।
আদালত বলেন, সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে তাতে সবার ক্ষতি হবে।
হাইকোর্ট আইনজীবীদের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, মেসেজ জানিয়ে দেবেন আমরা যেতে চাইলে অনেক দূর যেতে পারি। আমরা কিন্তু আইনজীবীদের সনদ আজীবনের জন্য বাতিল করতে পারি। আদালত অবমাননা তো আছেই। আবার নমনীয়ও হতে পারি। এটাই আমাদের মেসেজ। পরে আদালত সময় আবেদন গ্রহণ করে এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।
আদালতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আইনজীবীদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, বার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল, বার কাউন্সিলের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা, অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু,অ্যাডভোকেট বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ বিচারকাজ বিঘ্নিত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মফিজুর রহমান বাবুলসহ ২১ আইনজীবী হাইকোর্টে হাজির হন।
গত ১০ জানুয়ারি এ অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ২১ আইনজীবীকে তলব করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ২১ আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করা হয়। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন।
জেলা জজ আদালতে এজলাস চলার সময় বিচারকের নামে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিচার বিঘ্নিত করা এবং বিচারকের মানহানি করার বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করে প্রধান বিচারপতির কাছে গত ৯ জানুয়ারি আবেদন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগার।
আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, গত ২ জানুয়ারি এজলাস চলার সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অশালীন ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের কনটেম্পট ব্যাচ রুল জারি করার পর অভিযুক্ত আইনজীবীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গত ৫ জানুয়ারি এবং ৮ জানুয়ারি এজলাস চলাকালে বিচারকের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন।
জেলা জজের এই আবেদনপত্র প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন।